|
|
|
|
|
‘পাঠককেও দীক্ষিত হতে হবে’
এ রাজ্যের প্রান্তিক মানুষের গল্পকথক তিনি।
রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বললেন আশিস পাঠক। |
|
গ্রামের গল্প নাকি শহরের গল্প কোনটায় আপনি বেশি স্বচ্ছন্দ?
এ ভাবে আদৌ জল-অচল ভাগ করা যায় না। ভৌগোলিক ভাবে গল্পের পটটা গ্রাম হতে পারে, কিন্তু সেটা শিকড়। ডালপালাটা আকাশেই মেলতে হয়, তখন আর গ্রাম-শহর ভাগ থাকে না। একই সঙ্গে তখন কথাসাহিত্য আঞ্চলিক এবং বিশ্বায়িত। তবে আমি গ্রামের ছেলে, শৈশব-কৈশোর কেটেছে বাঁকুড়া জেলায়। সেই শিকড় থেকে একটা উত্তরাধিকার পেয়েছি। সেটা শুধু বিষয়ে নয়, কথনরীতিতেও। আমাদের কথকতার রীতিটাকে আমি আমার গদ্যে সচেতন ভাবে ব্যবহার করেছি।
নাকি গল্প বলার ঔপনিবেশিক রীতিটাকে অস্বীকার করতে চেয়েছেন?
ঠিক তাই। বলতে পারো, এ এক রকম নিজের ঘরে ফেরা। কারণ আমার কাছে কী লিখব, তার থেকেও কেমন করে লিখবটা বেশি জরুরি। আমার পাঠককে গোলগোল করে একটা গল্প আমি শোনাতে চাইনি। আমার আখ্যান তৈরি হয় যেন একটা মেলার মতো। হঠাৎ জমে না, আস্তে আস্তে জমে ওঠে, উঠতে থাকে। তার পরে ধুলোট। গল্প বলার এই রীতিটাই তো ভারতের নিজস্ব। ছোটবেলা থেকে রামায়ণ-মহাভারত পাঠ শুনেছি, কৃষ্ণযাত্রা দেখেছি। এগুলোকে, এই গোটা একটা সংস্কৃতিকে আমরা কী রকম গ্রামের বলে ছাপ মেরে দিয়েছি। ঔপনিবেশিক শহর যেন একটা পরিখা গড়ে তুলেছে নিজের চার দিকে। সাংস্কৃতিক দূরত্বটা কিন্তু এমন হওয়ার কথা নয়। |
|
নিজের পড়ার ঘরে লেখক। ছবি: শুভাশিস ভট্টচার্য। |
কথকতার রীতি দিয়ে সেই পরিখাটা কী করে পেরোবেন?
একজনের কথা বলি। আমাদের পাশের গ্রামের টেলু চক্রবর্তী রামায়ণ গান করত, এখনও করে। চামরের দোলায় অযোধ্যার সুখ আর অশোকবনের দুঃখ ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। এর মাঝেই দোয়ারিদের হাতে সুর ছেড়ে চা-বিড়ি খেতে যায়, প্রণামীর চাল কম হলে মুখ খারাপ করে। তারপর মুখে জল ছিটিয়ে আবার আসরে ফেরে। তখন সীতার দুঃখে মানুষজনের বুক ফাটে। এই ভাবে একটা সম্পূর্ণতা গড়ে ওঠে, একটা প্রেক্ষিতে একটা সৃষ্টি হয়ে ওঠে। এটাই ভারতীয় রীতি। প্রাচ্যদেশে গল্প বলার যত আঙ্গিক গড়ে উঠেছিল পাশ্চাত্য দেশে কিন্তু তত গড়ে ওঠেনি। এই ভারতীয়ত্বের সন্ধান করতে হবে আমাদের। সেটাকে বিকল্প সংস্কৃতি বললে কিন্তু ভুল হবে। সেটাই ভারতীয় সংস্কৃতি, বরং ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিটা বিকল্প।
যদি বলি নতুন গল্পের অভাবের জন্যই ‘ধনপতির সিংহলযাত্রা’ উপন্যাসে মধ্যযুগের চণ্ডীমঙ্গলের আশ্রয় নিয়েছেন?
একেবারেই না। আমার অন্য উপন্যাসে তো গল্পের অভাব নেই। তা ছাড়া শুধু গল্প বলতে আমি চাই না। আমি উপনিবেশ-পূর্ব বাংলার সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চেয়েছি এই উপন্যাসে। গঙ্গার দু’ধারে যে জনপদগুলো ছিল তাদের নামের সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার সম্পর্ক ছিল। হালিশহর, নবদ্বীপ, ললিতপুর, ইন্দ্রাণী ইত্যাদি নামের পুরাণ-ইতিহাস আমরা ভুলে গিয়েছি। ঔপনিবেশিক শাসনে হারিয়ে গিয়েছে প্রাচীন বাংলা ও বাঙালির অনেক পুরনো খাবার। ধনপতি-তে সেই যুগটাকে আমি নতুন করে নির্মাণ করতে চেয়েছি। ভাঙতে চেয়েছি আমাদের মানসিক ঔপনিবেশিকতাটাকে।
কিন্তু আপনার তৎসম শব্দবহুল ভাষা, গদ্যের গঠন কোথাও পাঠকের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে না?
কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না। পাঠককেও দীক্ষিত হতে হবে। তা ছাড়া, আমার ‘দুখে কেওড়া’ বা ‘ভবদীয় নঙ্গরচন্দ্র’-এ ভাষা অন্য রকম। ধনপতির সময়ের ভাষাটাকে ধরেছি এখানে, তা না হলে ওই আবহটা তৈরি হত না।
এখনও তারাশঙ্কর-মানিক-বিভূতিভূষণের উপন্যাস আপনাদের অনেকের চেয়ে বেশি বিক্রি হয়। কেন?
বিক্রিটা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তবে এটুকু বলতে পারি ড্রয়িং রুম স্টোরি থেকে বেরনো দরকার। ভারতবর্ষ শুধু সমকালে থাকে না, পূর্বকাল-ইহকাল-পরকাল অনেকটা জুড়ে তার বিস্তার, বেঁচে থাকা। আধুনিক উপন্যাসকে সেই জায়গাটা ধরতে হবে। ড্রয়িংরুম-বেডরুম আঁকড়ে থাকলে হয়তো উপন্যাস থেকে সিনেমা-সিরিয়াল হবে, কিন্তু উপন্যাসটা হবে না। আমাদের একটা উৎসব-অনুষ্ঠানেও ত্রিকাল লাগে, ত্রিলোক লাগে এই ব্যাপ্তিটাকে অনুভব করতে হবে। সেটাই বৃহত্তর ভারতীয় সংস্কৃতি, উপনিবেশ তাকে পিষে ছোট করে ফেলেছে।
|
পুরনো খবর: মঙ্গলযাত্রীকে আনন্দ-অভিবাদন
|
|
|
কলকাতার এক অনুষ্ঠানে জুহি চাওলা।— নিজস্ব চিত্র |
|
|
|
|
|