সারদা কাণ্ডে বিপন্ন ‘দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত’ আমানতকারীদের জন্য পাঁচ শত কোটি টাকার ত্রাণ তহবিল নির্মাণ করিয়া মুখ্যমন্ত্রী জনরোষ হইতে নিজেকে এবং নিজের দলকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতেছেন, না কি ইহার পিছনে কোনও সুপ্ত অপরাধবোধও কাজ করিয়াছে, সে প্রশ্ন অস্বাভাবিক নয়। রাজ্যসুদ্ধ আমানতকারী এবং এজেন্টরা সমস্বরে ঘোষণা করিয়াছেন, সরকার এবং শাসক দলের নায়কনায়িকাদের দেখিয়াই তাঁহারা সারদার উপর আস্থা রাখিয়াছিলেন। তাঁহাদের এই ঘোষণার তাত্পর্য মুখ্যমন্ত্রীর না-বুঝিবার কারণ নাই। কিন্তু যে কারণেই তিনি এই বিশেষ ত্রাণের আয়োজন করিয়া থাকুন, আয়োজনটি অনৈতিক এবং বিপজ্জনক। এমন ভয়ানক রকমের প্রতারণার কারবার যাঁহারা চালাইয়াছেন, তাঁহাদের শাস্তি অবশ্যই জরুরি। যাঁহারা সেই কারবারে টাকা ঢালিয়া ঠকিয়াছেন, আইনি পথে প্রতারকদের সম্পত্তি দখল করিয়া তাঁহাদের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য সমস্ত প্রকার চেষ্টা নিশ্চয়ই আবশ্যক। কিন্তু সরকারি কোষাগার হইতে, অর্থাত্ জনসাধারণের অর্থ হইতে সেই প্রতারণার মাশুল গনিলে তাহা করদাতাদের প্রতি ঘোর অন্যায় বলিয়াই গণ্য হইবে। রাজস্ব বৃদ্ধির তাগিদে মুখ্যমন্ত্রী নাগরিকদের বেশি করিয়া ধূমপান করিবার জন্য স্মিতহাস্য সহকারে যে আহ্বান জানাইয়াছেন, তাহা এমন ভয়ঙ্কর রকমের অবিবেচনার পরিচায়ক যে, কোনও নিন্দাই তাহার যোগ্য হইবে না। কিন্তু সেই অবিশ্বাস্য কুনাট্যরঙ্গে প্রবেশ না করিয়াও বলা চলে, ধূমপায়ীদের নিকট অর্জিত রাজস্বও অপব্যবহারের জন্য নহে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সঙ্কটে বিপন্ন ব্যাঙ্ক তথা লগ্নি সংস্থাকে সরকারি অর্থে বাঁচানো হইয়াছিল, সুতরাং এ ক্ষেত্রেও মুখ্যমন্ত্রী ঠিক করিয়াছেন এমন যুক্তি লইয়া সমস্যা আছে। প্রথমত, এ ধরনের যে কোনও ত্রাণের নীতিই আদর্শ হিসাবে সমর্থনযোগ্য নয়, মার্কিন সরকারকেও সেই সমালোচনা শুনিতে হইয়াছিল। দ্বিতীয়ত, সে ক্ষেত্রে যুক্তিটি ছিল বাস্তবতার এত বড় আর্থিক সংস্থাকে লাটে উঠিতে দিলে অর্থনীতি সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হইবে, সুতরাং তাহাদের পরিত্রাণ জরুরি। চিট ফান্ডের বিপর্যয় তাহার তুল্য হইতে পারে না। তৃতীয়ত, যে কারবারের পাকে এই বিপন্ন মানুষগুলি পড়িয়াছেন, তাহার সহিত লেমান ব্রাদার্সদের তুলনা চলে না, এ ক্ষেত্রে সমগ্র কারবারটিই কার্যত প্রতারণামূলক। চতুর্থত, এক বার এমন ‘ত্রাণ প্রকল্প’ চালু হইলে ভবিষ্যতে অনুরূপ যে কোনও সঙ্কটে ত্রাণের দাবি উঠিবে, সেই দাবি অমান্য করিবার নৈতিক যুক্তি সরকারের হাতে থাকিবে না। ‘এত লক্ষ মানুষ প্রতারণার শিকার হইলে তবে সরকার তাঁহাদের বাঁচাইবে’ ইহা কোনও নীতি হইতে পারে না। সর্বোপরি, ঝুঁকির কারবারে টাকা ঢালিয়া সব হারাইলে সরকার বাঁচাইয়া দিবে, এই ধারণা জনমানসে প্রতিষ্ঠিত হইলে অগ্রপশ্চাত্ বিবেচনা না করিয়া অতিলাভের আকর্ষণে ঝুঁকি লইবার প্রবণতা উত্তেজিত হইতে বাধ্য। ব্যক্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এত দূর ভাবিয়া দেখিবার অভ্যাস না থাকিতে পারে। কিন্তু তিনি কেবল ব্যক্তি নহেন, মুখ্যমন্ত্রী। |