কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম বিরোধী দলকে সংসদের অধিবেশন চালু রাখিবার জন্য অনুরোধ জানাইয়াছেন। বিভিন্ন প্রশ্নে ভারতীয় জনতা পার্টি কেন্দ্রীয় সরকার তথা প্রধান শাসক কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সমালোচনার সুর যে ভাবে চড়াইয়াছে, প্রধানমন্ত্রীর ইস্তফার দাবিতে যে ভাবে রণং দেহি মূর্তি ধরিয়াছে, তাহাতে সংসদের বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্ব বানচাল হইবার আশঙ্কা প্রবল। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য, এই অধিবেশনে (খাদ্য নিরাপত্তা, জমি অধিগ্রহণ, বিমা সংস্কার ইত্যাদি বিষয়ক) অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ করানো আবশ্যক। বিরোধীরা সাহায্য না করিলে সেই কাজগুলি পণ্ড হইবে, তাহাতে দেশের বড় ক্ষতি। কথাটি যুক্তিসঙ্গত। কেবল বিল পাশ করানোর প্রয়োজনে নহে, সাধারণ ভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু ও কার্যকর রাখিবার স্বার্থেই সংসদের অধিবেশন যথাযথ ভাবে চলা জরুরি। অথচ এ দেশে সংসদীয় বিতর্ক উত্তরোত্তর রাস্তার রাজনীতির দাপটে বানচাল হইতেছে। কী কেন্দ্রে, কী রাজ্যে, জনপ্রতিনিধিরা যথার্থ বিতর্ক ও আলোচনা হইতে ক্রমশই মুখ ফিরাইয়া লইতেছেন। এ বিষয়ে সমস্ত দলই কার্যত এক কুপথের পথিক। এন ডি এ আমলে কংগ্রেস নানা ভাবে লোকসভার কাজ পণ্ড করিয়াছে, এখন বি জে পি সেই ঐতিহ্য সমানে চালাইতেছে। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তাহার অভিযোগগুলি সঙ্গত হইতেই পারে। কিন্তু তাহার জন্য সংসদ বানচাল করিবার কোনও যুক্তি নাই, বরং গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ এবং সমালোচনার প্রথম ও প্রধান মঞ্চটির নামই সংসদ।
প্রশ্ন হইল, সংসদ বানচাল করিবার গণতন্ত্রবিরোধী সাধনার এই সর্বদলীয় ঐকমত্যকে ভাঙার উপায় কী? দলনায়ক বা জনপ্রতিনিধিরা স্বতঃস্ফূর্ত শুভবুদ্ধির প্রেরণায় এই কাজে ব্রতী হইবেন বলিয়া ভরসা হয় না। অন্তত অভিজ্ঞতা তাহার প্রতিকূল সংসদের দৃশ্যাবলি টেলিভিশন যোগে সম্প্রচারিত হইবার পরেও তাঁহাদের আচরণ উন্নততর হয় নাই। সম্ভবত, কিছু তিক্ত ঔষধ আবশ্যক। কার্যকারিতা বিচার করিয়া ঔষধের মাত্রা কালক্রমে বাড়ানোও আবশ্যক হইতে পারে। যেমন, প্রথমেই এই নিয়ম চালু করা যায় যে, কোনও সাংসদ সঙ্গত কারণ ছাড়া অনুপস্থিত থাকিলে অথবা সভা পণ্ড করিবার উদ্যোগে যোগ দিলে তাঁহার প্রাপ্য ভাতা ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা ছাঁটাই করা হইবে। ইহার যুক্তি সহজ ও সরল। সংসদ তাঁহাদের কাজের জায়গা, কাজের জন্যই জনসাধারণ তাঁহাদের সেখানে প্রতিনিধি হিসাবে প্রেরণ করিয়াছেন, কাজ না করিলে কাজের ‘মূল্য’ তাঁহারা পাইবেন কেন? কোন হিসাবে?
ইহা প্রাথমিক নিদানমাত্র। ইহাতেই কাজ হইবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নাই। যদি না হয়, যদি কোনও সাংসদ বারংবার একই নেতিবাচক আচরণ করিতে থাকেন, তাহা হইলে তাঁহার ভোটে দাঁড়াইবার বা এমনকী নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অধিকার খর্ব করিবার কথা ভাবা যায়। তর্ক উঠিতে পারে, এ দেশে আইনসভার কাজে বাধা সৃষ্টির উদ্যোগগুলি তো প্রায় সর্বদাই দলীয় উদ্যোগ, ব্যক্তি অপেক্ষা দলকে চাপ দেওয়াই অধিক যুক্তিযুক্ত নয় কি? কথাটি উড়াইয়া দেওয়ার নয়। তবে, প্রথমে জনপ্রতিনিধিদের উপর ব্যক্তিগত ভাবে চাপ দেওয়ার যৌক্তিকতা আছে, কারণ ভারতীয় সংবিধান ‘দল’কে স্বীকার করে না, সাংসদ বা বিধায়কের সাংবিধানিক দায়িত্ব দলের অনুগত সদস্য হিসাবে নহে, ব্যক্তি-প্রতিনিধি হিসাবে। শাস্তির মাধম্যে সেই বোধ যদি তাঁহাদের মধ্যে জাগ্রত করা যায়, তাঁহারা হয়তো দলের উপরেও আত্মসংশোধনের জন্য চাপ সৃষ্টি করিতে উত্সাহিত বা তাড়িত হইবেন। যদি তাহা না ঘটে অথবা তাহাতে ফল না মেলে, তবে শাসনদণ্ডটি সরাসরি সংশ্লিষ্ট দলের প্রতি প্রয়োগ করাও জরুরি হইতে পারে; যথা, সংশ্লিষ্ট দলকে সাময়িক ভাবে নির্বাচনের ময়দানে নিষিদ্ধ করা যায়। এই পথই হয়তো একমাত্র পথ নয়। হয়তো অন্য চিকিত্সাও সম্ভব। কিন্তু চিকিত্সা জরুরি, এই সত্যটি স্বীকার করিতে হইবে। ‘ভারতীয় গণতন্ত্র খাসা আছে’ অথবা ‘সামান্য অসুখ, নিজেই সারিয়া যাইবে’ বলিয়া ভাবের ঘরে চুরি করিলে ব্যাধি আরও বাড়িবে। |