বিচারক বা আইনজীবীরা কী বলছেন, তা শুনতে যেন বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তাঁর। এমনকী ১৪ দিনের জন্য (৮ মে পর্যন্ত) পুলিশি হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশটা শুনতেও ছিটেফোঁটা তৎপরতা দেখা গেল না। গালে দিন দুয়েকের না-কাটা দাড়ি। পরনে কালো স্ট্রাইপের ধূসর ফুলশার্ট। এজলাসের জালে-ঘেরা লকআপে ভাবলেশহীন চোখে বসে বসেই বৃহস্পতিবার দুপুরে একটি ঘণ্টা কাটিয়ে দিলেন সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেন।
সুদীপ্ত ও অরবিন্দ চৌহানের থেকে খানিকটা দূরে বিচারকের আসনের ডান দিকে এজলাসের দেওয়াল-ঘড়ির নীচে দাঁড়িয়ে ছিলেন দেবযানী মুখোপাধ্যায়। আইনজীবীদের বাকযুদ্ধ চলাকালীন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মাঝেমধ্যে থরথরিয়ে কেঁপে উঠেছেন কালো ওড়নায় মুখ-ঢাকা ফুলছাপ সালোয়ার-কামিজের তরুণী। জোরদার সওয়াল-জবাবের সময়ে এক বার হঠাৎ টাল রাখতে না-পেরে বসে পড়লেন। মহিলা পুলিশকর্মীরা সঙ্গে-সঙ্গে এগিয়ে গেলেন তাঁর দিকে।
ধৃতদের মধ্যে আপাতত দেবযানীই কিছুটা ভেঙে পড়েছেন বলে জানাচ্ছেন তদন্তকারী অফিসারেরা। পুলিশ সূত্রের খবর, শোনমার্গে ধরা পড়া ইস্তক দেবযানী অন্য দুই অভিযুক্তের সঙ্গে পারতপক্ষে কোনও কথা বলেননি। পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন, ‘সেন-স্যার’কে বিশ্বাস করে দিল্লির মিটিংয়ে যোগ দিতে যাওয়াই ভুল হয়েছে তাঁর। |
কেন এ কথা বলছেন দেবযানী? তদন্তকারীদের দাবি, সুদীপ্তবাবু এবং দেবযানীকে জেরা করে একটি বিষয় সম্পর্কে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন। ১০ এপ্রিল সুদীপ্তবাবুর সঙ্গে গাড়িতে রাঁচি যাননি দেবযানী। ক’দিন পরে দেবযানী কলকাতা থেকে সটান বিমানে চেপেই দিল্লি গিয়েছিলেন। জরুরি মিটিং-এর নাম করে সুদীপ্তবাবু দেবযানীকে সেখানে ডেকে পাঠিয়েছিলেন বলে তদন্তকারীদের দাবি। মঙ্গলবার দেবযানীর আত্মীয়েরাও একই দাবি করেছিলেন। সবারই বক্তব্য, ‘সেন স্যার’-এর ডাকে দিল্লি না গেলে দেবযানীকে এ ভাবে হেনস্থার মুখে পড়তে হত না। পুলিশ সূত্রের খবর, দিল্লি থেকে এর পরে দেবযানীকে নিয়েই পঞ্জাব, উত্তরাখণ্ড হয়ে কাশ্মীরে পৌঁছন সুদীপ্তবাবু। দেবযানীর আইনজীবীদের দাবি, দেবযানী নিজে ১৬ তারিখ হরিয়ানার সোনপেট থেকে এবং ১৮ তারিখ চণ্ডীগড় থেকে কলকাতায় ফেরার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ফেরা হয়নি।
তবে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পরে তদন্তকারীদের মনে হয়েছে, দেবযানী তদন্তে সাহায্য করতে রাজি। অফিসের মিটিংয়ে যোগ দিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কলকাতা থেকে অনেক দূরে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার বিষয়টি মন থেকে মানতে পারেননি ওই তরুণী। পুলিশের সঙ্গে কলকাতায় ফিরেও মনমরা হয়ে রয়েছেন। আদালত অবশ্য তাঁকে জেরার সময় আইনজীবীকে উপস্থিত থাকার অনুমতি দিয়েছে। তদন্তকারীদের দাবি, সারদা সংস্থায় যাঁরা সুদীপ্তবাবুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ তাঁদের অনেকেই নানা তথ্য দিয়ে তদন্তে সাহায্য করছেন। তার ভিত্তিতেই পুলিশ একটি নামের তালিকা তৈরি করেছে। প্রয়োজনে সারদা সংস্থার বিভিন্ন কর্তা, মহিলা কর্মচারীদের সঙ্গে বসিয়ে দেবযানীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে ইঙ্গিত। |
বুধবার রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ সুদীপ্ত, দেবযানী ও অরবিন্দকে কলকাতায় নিয়ে আসার পর থেকে পুলিশ অভিযুক্তদের অতি সাবধানে আগলে রেখেছে। রাতে অরবিন্দকে বিধানগরের ইলেক্ট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানায় রাখা হয়েছিল। সুদীপ্ত ও দেবযানী ছিলেন নিউটাউন থানায়। প্রথমে কিছু ক্ষণ দু’জনকে আইসি-র ঘরে বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন কমিশনারেটের উচ্চপদস্থ কর্তারা। এর পরে রুটি ও আলু-এঁচোড়ের তরকারি নিয়ে নৈশাহার। থানায় দু’টি আলাদা লক আপে দু’জনের শোওয়ার ব্যবস্থা হয়। দু’জনকেই একটি করে কম্বলও দেওয়া হয়েছিল।
এ দিন সকালেই তিন জনকে বিধাননগর উত্তর থানায় নিয়ে আসা হয়। সকাল ৬টা নাগাদ সুদীপ্ত ও দেবযানীকে নিয়ে পুলিশের একটি দল চলে আসে বিধাননগর উত্তর থানায়। তার প্রায় এক ঘণ্টা পরে ৭টা নাগাদ সেখানে আনা হয় অরবিন্দকেও। তত ক্ষণে সুদীপ্তরা কোথায় রয়েছেন, তা জানাজানি হয়ে গিয়েছে। থানার বাইরে তখন থেকেই এজেন্ট-আমানতকারীদের ভিড়। স্লোগান-বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। ভিতরে বসে সুদীপ্তরা তখন চা, ডিম-টোস্ট দিয়ে প্রাতরাশ সারছেন। তবে দেবযানী চা ছাড়া কিছু দাঁতে কাটেননি। বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালের ডাক্তারেরা ওই থানায় এসেই সুদীপ্তদের ডাক্তারি পরীক্ষা করেন। ধৃতদের কারও মধ্যেই অসুস্থতার লক্ষণ ধরা পড়েনি।
বেলা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে থানার বাইরে বিক্ষোভও বাড়তে থাকে।
বেলা ১১টা নাগাদ একদল কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকও আসরে নামেন।
বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে কটূক্তি, ধাক্কাধাক্কির মধ্যেই অভিযুক্ত তিন জনকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়িতে তোলার ব্যবস্থা করে পুলিশ। একটি প্রিজন ভ্যানে তোলা হয় সুদীপ্ত-দেবযানীকে। অরবিন্দকে পুলিশের অন্য একটি গাড়িতে তোলা হয়। সুদীপ্তদের গাড়ির পিছনে ‘চিটিংবাজ, চিটিংবাজ’ বলতে বলতে ছুটতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা।
বিধাননগর এসিজেএম আদালতে পৌঁছে আগাগোড়া কালো ওড়নায় মুখ আড়াল করে রেখেছিলেন দেবযানী। তবে সুদীপ্ত বা অরবিন্দর সে-দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। ময়ূখ ভবনে আদালত-চত্বরেও সকাল থেকে এজেন্ট, আমানতকারী, কৌতূহলীদের ভিড়। ধৃত তিন জন আদালতে পৌঁছলে বাইরে রীতিমতো বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। তাতে যোগ দেন কংগ্রেস ও বিজেপি কর্মী-সমর্থকরাও। ময়ূখ ভবনের সিঁড়িতে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। |
সুদীপ্ত, দেবযানী ও অরবিন্দের হয়ে এ দিন জনা ১৫ আইনজীবী সওয়াল করেন। সুদীপ্তর আইনজীবীরা বলেন, তাঁদের মক্কেলের বিরুদ্ধে তিন মাস বেতন না-দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এর সঙ্গে প্রতারণার কোনও সম্পর্ক নেই। অন্য দিকে দেবযানীর আইনজীবীর অভিযোগ, তাঁর মক্কেল সংস্থার অধিকর্তা নন। সাধারণ কর্মী। তাঁদের বক্তব্য, এফআইআরে দেবযানী ও অরবিন্দ চৌহানের নাম নেই। সরকারি আইনজীবী সাবির আলি বলেন, “দেবযানীদেবী যে অধিকর্তা ছিলেন তার প্রমাণ পুলিশের কাছে আছে। মূল অভিযোগ অর্পিতা ঘোষের। তিনি পুলিশকে আরও জানিয়েছেন, এই সংস্থা টাকা জমা রাখার জন্য মানুষকে লাভ ও চড়া সুদ দেবে বলে ঠকাচ্ছে। তদন্ত করে পুলিশ বেশ কিছু তথ্য জোগাড় করেছে।”
মামলা শেষে তিন জনকে এজলাসের বাইরে বের করতেও হিমসিম খায় পুলিশ। প্রিজন ভ্যানের সামনে শুয়ে পড়ে বিক্ষোভ দেখান কংগ্রেস সমর্থকেরা। পুলিশকে লাঠি নিয়ে বারবার ছুটে যেতে হয়। বিকেল চারটে নাগাদ তিন জনকে নিয়ে প্রিজন ভ্যান নিউটাউন থানার উদ্দেশে রওনা হয়ে যায়। এ দিন রাতে সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনকে দফায় দফায় জেরা করেন বিধানগরের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার ও গোয়েন্দা প্রধান অর্ণব ঘোষ। প্রাথমিক ভাবে পুলিশ জানতে পেরেছে, দু’মাস আগে থেকেই নিজের সংস্থা গোটানোর পরিকল্পনা করেছিলেন সুদীপ্ত। সেই কারণে সংস্থার টাকা এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে সরিয়ে ফেলতে নির্দেশ দিয়েছিলেন কর্মীদের। |