|
|
|
|
শ্রাবন্তী ২৬ মিনিট লাই ডিটেক্টর |
শ্রাবন্তী এখন যেমন রঙিন। পছন্দে তেমনই আবার সাদাকালো।
দু’ধরনের ছবিতেই তাঁর কাজ করা চাই। দেখে এলেন ইন্দ্রনীল রায় |
বেহালা ফ্লাইং ক্লাবের রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে তখন তাঁর ছবিরই গান বাজছে। রাস্তা গুলিয়ে যাওয়ায় চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করাতেই পাড়ার লোকেরা শুধু বাড়ি অবধি পৌঁছেই দিলেন না, “দাদা, শ্রাবন্তী বিশ্বাস কিন্তু আজকের টপ হিরোইন, আমাদের গর্ব,” এটাও সমস্বরে বলেন। তাঁর ফ্ল্যাটের নেমপ্লেটে লেখা অভিমন্যু তাঁর ছেলের নাম। গল্ফ গ্রিনের শ্বশুরবাড়ি নয়। যেতে বললেন পর্ণশ্রীর বাড়িতে। পৌঁছতে লেগে গেল প্রায় আধ ঘণ্টা। ড্রয়িং রুমে তাঁর মুখের বিরাট ক্লোজ আপ। এর মধ্যেই হাতে দু’টো ফোন নিয়ে ঘর থেকে বেরোলেন শ্রাবন্তী। “ইন্টারভিউ শুরু করার আগে একটু চা করতে বলি?”
অফিস থেকে ছাব্বিশ মিনিট লাগল আপনার বাড়ি পৌঁছতে।
হা হা হা হা, বুঝতে পেরেছি কী প্রশ্ন আসতে চলেছে।
বুঝেই যখন গিয়েছেন, তখন বলুন। ‘গয়নার বাক্স’ থেকে ২৬ মিনিট কাটা হল, না আপনার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিন কাটা হল?
এটা নিয়ে আমি কী বলব বলুন? অপর্ণা সেন অনেক বড় ডিরেক্টর, অনেক বেশি বোঝেন, জানেন। লেজেন্ড উনি। ওঁর যখন মনে হয়েছে এটা ঠিক, তখন আর তো কিছু বলার থাকতে পারে না। তবে আমার খুব ফেভারিট তিনটে সিন কাটা গিয়েছে। প্রথমটা ছিল, যেখানে আমি বোলপুরের জঙ্গলে ওয়েট করতে করতে সিগারেট খাচ্ছি। ওই সিনটা আমার কাছে ইমোশনালও খুব।
কেন?
ওটাই তো ফার্স্ট ডে অব শুটিং ছিল। কিন্তু হয়তো ছবি খুব বড় হয়ে গিয়েছিল তাই বাদ দিতে হল। আর একটা মন্দিরের সামনের সিন ছিল, আর লাস্টে আর একটা সিন ছিল যেখানে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে গয়না তুলে দিচ্ছি। এই তিনটে সিনই বাদ চলে গেল। |
|
এত গুরুত্বপূর্ণ সব সিন বাদ চলে যাচ্ছে, কথা বলেননি অপর্ণা সেনের সঙ্গে?
না বলিনি।
কঙ্কনা সেন শর্মার সিন হলে উনি এত সহজে বাদ দিতে পারতেন?
সেটা আমি কী করে বলব। তবে উনি কিন্তু ভীষণ প্রফেশনাল। সব খুঁটিনাটি ব্যাপারে ওঁর নজর থাকে। মনে আছে একটা সিন, কৌশিকের একটা নতুন পাঞ্জাবি কেনা হয়েছিল। কিন্তু সেটাকে যাতে পুরনো লাগে, ইউজড লাগে, তাই নিজেই সেটাতে শিরীষ কাগজ ঘষছিলেন। উনি এতটাই কমিটেড।
আর সিন কাটা নিয়ে আমি ভাবছি না, ছবি তো দারুণ চলছে। ছবি ভাল চললে সব ঠিক আছে। আর উনি তো আমাকে প্রথমেই বলেছিলেন, শ্রাবন্তী, তোমার কিন্তু ৯-১০ দিনের কাজ আছে। শ্রীকান্তদাও একই কথা বলেছিলেন। আর আমাকে বহু লোক বলেওছেন ছবিটা লম্বা, শেষটুকু নিয়ে অনেকেরই অসুবিধা হয়েছে। তাও বলছি, ‘গয়নার বাক্স’ আমার কাছে সব সময় খুব স্পেশাল ফিল্ম। তাই যা হয়েছে ঠিক হয়েছে বোধ হয়। এই ছবিটা করা আমার নিজের ডিসিশন ছিল। তাই কোনও আক্ষেপ নেই।
আপনার জার্নিটা তো ইন্টারেস্টিং। সম্পূর্ণ অন্য ধারার ছবি থেকে...
হ্যাঁ, সম্পূর্ণ অন্য ধরনের ছবিতে থেকে এ রকম ছবি করাটা শুধু ইন্টারেস্টিংই নয়, খুব ফ্যাসিনেটিংও...
এ বার কি তাহলে শ্রাবন্তীকে অন্য ধরনের ছবি করতে বেশি দেখা যাবে?
আমি ব্যালেন্স রাখতে চাই। দু’ধরনের ছবি করতেই কোনও আপত্তি নেই আমার। আর দর্শক তো আজকাল এ ধরনের ছবি খুব পছন্দ করছে। যদিও শ্রাবন্তী, শ্রাবন্তী হয়ে উঠেছে কমার্শিয়াল ছবি করে, কিন্তু ‘গয়নার বাক্স’র জগৎটা আমার ভাল লাগছে। বেশ অন্য রকমের।
কী রকম?এখানে ওয়ার্কশপ করতে হয়। অভিনয় করার সময় ‘পজ’ বেশি নিতে
হয়। ভাবতে হয় সিনগুলো
নিয়ে। আজকে তো দেব-ও এ রকম ছবি করছে। ‘চাঁদের পাহাড়’-এর
মতো ছবি হচ্ছে। আমি তো সে
দিন শ্রীকান্তদা আর লালুদাকে
বলছিলাম ‘চাঁদের পাহাড়’-এ একজন বাঙালি মেয়ের চরিত্র রাখো না
প্লিজ, যে হঠাৎ দক্ষিণ আফ্রিকা পৌঁছে যায়। আমার খুব ইচ্ছে এ রকম ছবি এখন করার। তার জন্য আলাদা কোনও স্ট্র্যাটেজি নিয়েছেন? ওই ধরনের ছবির পরিচালকদের ফোনটোন করছেন?
না, স্ট্র্যাটেজি কিছু ও ভাবে এখনও ঠিক করিনি। তবে হ্যাঁ, সৃজিত মুখোপাধ্যায়, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় আর টোনিদার সঙ্গে আমি কাজ করতে চাই। অভিনয়টা এত ভালবাসি না, তাই ইচ্ছে করে অন্য রকমের একটু ছবি করি।
আপনি যে ধরনের ছবি করেন, সেই ছবির সেটে আপনাকে হিরোইন হিসেবে চূড়ান্ত প্যাম্পার করা হয়। কিন্তু অপর্ণা সেন বা সৃজিতের সেটে তো সেটা হবে না। সেই মেন্টাল অ্যাডজাস্টমেন্টটা করেছেন?
ওই মেন্টাল অ্যাডজাস্টমেন্ট করাটা আমার কাছে ডিফিকাল্ট নয়। ভাল ছবি হলে, দারুণ রোল হলে, আমার নিজেকে নিউকামার ভাবতে কোনও আপত্তি নেই। অন্য ধরনের ছবিতে ভাল অভিনয় করাটা আমার কাছে চ্যালেঞ্জ। ‘গয়নার বাক্স’তে নিজেকে নিউকামার ভেবেছিলেন?
অবশ্যই ভেবেছিলাম। অপর্ণা সেন বা সোহাগ সেনকে জিজ্ঞেস করবেন। ওঁরা আমার ব্যবহারের খুব প্রশংসা করবেন।
কীসের প্রশংসা করবেন না?
(হেসে) আবার...দাঁত কামড়ে নেওয়ার প্রশংসা করবেন না।
দাঁত কামড়ে নেওয়া মানে?
আমার একটা গজদাঁত আছে। কিন্তু ওঁরা চেয়েছিলেন আমার দু’দিকেই গজদাঁত থাকুক। তাই আলাদা করে একটা গজদাঁত বানানো হয়েছিল। সেটা আমি কামড়ে ফেলেছিলাম। বকুনিও খেয়েছিলাম। আমি দাঁতটা নিয়ে খেলতাম, জিভের ওপর রেখে ভয় দেখাতাম সবাইকে। অত সিরিয়াস থাকতে পারি না সেটে। |
|
‘কোকাকোলা’ শ্রাবন্তী |
একটা কথা প্রায়ই শুনছি আজকাল।
কী? শোনা যাচ্ছে আপনার আর রাজীবের সম্পর্কের মধ্যে নাকি নানা সমস্যা হচ্ছে?
এটা নিয়ে কি আলোচনার কোনও দরকার আছে? এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই না। প্রফেশনাল কথাবার্তাই হোক না ইন্টারভিউতে।
প্রফেশনাল কথাবার্তা তো হল অনেকটাই।
হ্যাঁ, কিন্তু এই ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই।
কিছু বলার নেই মানে কিন্তু অনেক কিছু বলে ফেললেন আপনি?
দেখুন, সব বিয়েতেই কিছু না কিছু ঝামেলা থাকে। আমি সময়ের ওপর বিশ্বাস রাখি। যদি কিছু হয় তা হলে সবাই জানতে পারবেন।
রাজীব নাকি অন্য পরিচালকদের সঙ্গে আপনার কাজ করা নিয়ে একটু আনকমফর্টেবল?
কই না তো! আমি বেশি কাজ করেছি তো রবি কিনাগি আর রাজীবের সঙ্গেই। রাজীব তো ফ্যামিলি। হ্যাঁ, কিছু কাজ রাজের সঙ্গেও করেছি। রাজীব আর রাজ দু’জনেই খুব অরগানাইজড। যদিও রাজের টিমটা খুব ভাল। রাজীব নিজে সব সামলায়।
পর্ণশ্রীর এই যে ফ্ল্যাটে আপনার ইন্টারভিউ করছি, এখানেই তো আপনার মা-বাবা থাকেন?
হ্যাঁ, এটা মা-বাবার জন্যই কিনে দিয়েছি। অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল মা-বাবাকে কিছু দেওয়ার। এটা আমার গিফ্ট।
|
রাজীব বিশ্বাস |
আজকাল তো আপনি এখানেই থাকছেন?
হ্যাঁ, শুটিংয়ের জন্য কয়েক দিন এখানেই থাকছি।
আপনার শ্বশুরবাড়ি কোথায়?
এমনিতে শ্বশুরবাড়ি কৃষ্ণনগরে। কলকাতায় গল্ফ গ্রিনে।
এটাও শুনি রাজীব নাকি আপনাকে নিয়ে ইনসিকিওরড?
কেন বলুন তো? বৌ নায়িকা, টপ হিরোইন, প্রচুর নাম, অনেক অ্যাডমায়ারার...
না, ওটা কোনও অসুবিধা নয় আমাদের মধ্যে। আজ রাজীব নিজেও বড় পরিচালক। ইনসিকিউরিটিটা মনে হয় না ঠিক। ও সব নিয়ে ভাবতেও চাই না। আমি আমার কাজের প্রতি ভীষণ ফোকাসড। আমি যেহেতু পাঁচ বছর কাজ করিনি... আফসোস হয় কখনও, ২০০৩-য়ে হিরোইন হয়েও পাঁচ বছর কাজ করেননি বলে?
একটু তো হয়ই। তবে লোকে আমায় ভুলে যায়নি। মানুষের এটা মনে ছিল যে শ্রাবন্তী বলে একজন হিরোইন আছে... কী করতেন ওই পাঁচ বছর? ফ্রাসট্রেটিং লাগত না?
এক এক সময় লাগত। বাড়ির কাজ করতাম, ছেলে সামলাতাম, টিভি দেখতাম।
মানে পুরোপুরি হাউজওয়াইফ?
একদম। আমার অ্যাডজাস্ট করতে অসুবিধা হয় না। আমি তো পাড়ার টিউবওয়েল থেকে জলও এনেছি।
তখন কোথায় থাকতেন আপনারা?
বিজয়গড়ে। কিন্তু যেহেতু ছোটবেলা থেকে কাজ করেছি, কারও সামনে হাত পাততে লজ্জা হত। আমি এমনি ভীষণ মুখচোরা। নিজের জন্য কিছু লাগবে এটা বলতেই পারি না চট করে। অনেক মহিলাই আছেন আমার মতো। এটা মেয়েদের খুব কমন প্রবলেম। তাই নিজের হাতখরচ চালানোর জন্য আমি অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টরেরও কাজ করেছি।
অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর আপনি? কার?
রাজীবকেই অ্যাসিস্ট করতাম। এবং আমার সঙ্গে একদম অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টরের মতোই ব্যবহার করত রাজীব। সেই কাজ করে হয়তো মাসে ছ’হাজার টাকা উপার্জন করলাম। তখন সেটাই আমার কাছে অনেক। কী জানেন, আমি অনেক রকম জীবন দেখেছি। ভাল লাগে...
আপনার বৌ পাঁচ বছর সংসার করল। টিউবওয়েল থেকে জল তুলল। তার পর হঠাৎ এক দিন নায়িকা হয়ে খুব ফেমাস হয়ে গেল, বেশি টাকা উপার্জন করা শুরু করল। তাই কি রাজীব ইনসিকিওর?
ইনসিকিওর শুধু পুরুষেরা হয় না, মেয়েদেরও অনেক ব্যাপারে ইনসিকিওরড লাগে। আজকে তো রাজীবও অনেক বড় ডিরেক্টর। ওরও প্রচুর নাম।
সেটা ঠিক।
(অনেক ক্ষণ চুপ) আজকাল কি তা হলে লোকে বলছে রাজীব আমাকে নিয়ে ইনসিকিওরড?
হ্যাঁ, বলছে।
কারা বলছে?
অনেকেই বলছে। যারা আপনাদের দু’জনকেই চেনে।
আমার আর কিছুই বলার নেই।
এর মাঝখানেই তাঁর ছেলে অভিমন্যু এসে জড়িয়ে ধরল মাকে। “মা অনেক দিন তুমি আমাকে কোনও খেলনা কিনে দিচ্ছ না।” শ্রাবন্তী আর তখন নায়িকা নন, “আগের উইকেই তো হেলিকপ্টার কিনে দিলাম,” হেসে উত্তর দেন তিনি। আপনার ছেলে তো বেশ লম্বা?
হ্যাঁ, সবে আট বছর বয়স, কিন্তু এখনই আমার মাথায় মাথায়। খালি আমার সঙ্গে দুষ্টুমি করে।
কী দুষ্টুমি করে?
আমি তো বাইরে গেলে বলি আমাকে দিদি বলে ডাকবি। তা না করে ইচ্ছে করে ভিড়ের মধ্যে মা মা বলে চিৎকার করে। এত দুষ্টু। মণিদা আর শ্রীকান্তদা তো বলেছে, ও বড় হলে ওকে হিরো হিসেবে লঞ্চ করবে।
এরই মাঝখানে ছেলে খেলনা লাই ডিটেক্টর নিয়ে আসে তার মায়ের কাছে। “মা, এটাতে হাত দিয়ে বলো, যা বলেছ ইন্টারভিউতে সব ঠিক বলেছ?” আবদার করে অভিমন্যু। মা-ও ছেলের কথা শুনে হাত রাখেন লাই ডিটেক্টরে। জ্বলে ওঠে আলো। “মা, সব আলো জ্বলছে না। তার মানে তুমি ইন্টারভিউতে কিছু মিথ্যে বলেছ,” হেসে বলে অভিমন্যু।
মা শ্রাবন্তীও তখন হেসে কুটোপাটি। ঠিক সেই মুহূর্তে বন্ধ করে দিই আমার ডিক্টাফোন। |
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল |
|
|
|
|
|