শাহরুখ খান কেন তাঁর বিধ্বস্ত টিমের খেলা দেখতে আসছেন না, সেই অমীমাংসিত রহস্যের মতোই আরও একটা প্রশ্ন ক্রুদ্ধ নাইট সমর্থককে তাড়া করবে। খুব সম্ভবত নাইট অধিনায়ককেও। আইপিএল চ্যাম্পিয়নের চাপ কি কেকেআর নিতে পারছে না? নাকি খারাপ খেলার অন্য কোনও কারণ? কারণ যাই হোক, সাত ম্যাচে পাঁচটা হেরে তাদের ফের নামকরণ হওয়ার সময় হয়েছে কেকেহার!
শাহরুখ ঘনিষ্ঠমহলে একাধিক বার বলেছেন, আইপিএলে এই একটা ম্যাচ জেতার দিকে তিনি পরম আগ্রহে তাকিয়ে থাকেন— মুম্বই। গত বার ওয়াংখেড়েতে এমআই-এর সঙ্গে খেলা জিতে উঠেই কিনা সেই ভয়ঙ্কর গণ্ডগোল বেঁধেছিল তাঁর স্টেডিয়ামের নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে। এ দিন এত বড় ম্যাচ। তেন্ডুলকরের জন্মদিন। টিমকে মানসিক গাড্ডা থেকে টেনে তোলার দায়। সব কিছুকে অগ্রাহ্য করে এসআরকে সেই অনুপস্থিতই থাকলেন। আর স্লো টার্নারে টস জিতে ব্যাট করা নাইটরা এগিয়ে গেল এমন তলানির দিকে, যেখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, অন্য অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজির মতো তাদের জন্যও মনোবিদ রাখা উচিত কি না? নইলে তিন স্পিনার নিয়ে এই উইকেটে তাদের তোলা ১৫৯ তো অতিক্রান্ত হওয়ার কথা নয়।
মাঠ উপচে পড়া দর্শক দেখতে এসেছিল হয় কেকেআরের অনবদ্য জয়। নয়তো সচিনের চোখ ঝলসানো ইনিংস। দুটোতেই চরম ফাঁকি থেকে গেল।
অথচ শুরুতে মোটেও এমন বঞ্চিত হওয়ার ইঙ্গিত ছিল না। ইউসুফ পাঠান আজ অবধি নাইটদের হয়ে পঞ্চাশ করেননি-র মতোই অসামান্য কৃতিত্ব হল, নিজের সম্পর্কে হালফিল একটা এসএমএস জোকও তৈরি করতে পেরেছেন। আদালতে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের মামলা চলছে। জোর লড়াই চলছে সন্তানের অধিকার কে পাবে তা নিয়ে। বিচারক বাচ্চাটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি বাবার কাছে যাবে? সে বলল না, বাবা আমায় মারে। তিনি তখন বললেন, তা হলে কি মা-র কাছে যাবে? বাচ্চা বলল, না মা-ও মারে। বিচারকের শেষ প্রশ্ন, তা হলে তুমি কী করবে? বাচ্চাটি দ্রুত উত্তর দিল, আমি ইউসুফ পাঠানের কাছে থাকব। ও কাউকে মারে না! |
বুধবারের প্রথম বল দেখে মনে হল ইউসুফ আজ ঠিক করেছেন জোকস চালাচালি বন্ধ করে দেবেন। আর একটা কাজ করবেন। মাটি করে দেবেন সচিন তেন্ডুলকরের জন্মদিনের উৎসব। এমনিতে আজ বার্থডে গিফট পাওয়ার কথা সচিনের। বড়জোর আম্পায়ার ধর্মসেনার। তারও ছিল আজ জন্মদিন। কিন্তু উপহারটা পেয়ে গেলেন ইউসুফ। প্রথম ওভারেই স্পিনার। আর সেটা পেয়ে হরভজনের সঙ্গে যা তাণ্ডব শুরু করলেন, তাতে মনে হচ্ছিল ক্রিস গেইলের ১৭৫ রানের ব্যাটটা বুঝি বেঙ্গালুরু থেকে আনিয়েছেন। প্রথম ওভারে উঠল ২৬। ইউসুফ ৫ বলে ১৯। গম্ভীর— তিনিও মারমুখী। প্রথম তিন ওভার নাইটদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল কেক যা কাটার হয়ে গেছে। আর ওই সব সুখের পর্ব তারা বিপক্ষ ডাগ আউটে ঢুকতেই দেবে না।
এখানে মনে করিয়ে দিই, বুধবার সকাল থেকে যে পনেরোটা কেক সচিন তেন্ডুলকর তাঁর জন্মদিনে কাটলেন তার একটাও নাইটদের পাঠানো উপহার নয়। কেকেআরের উপহারের খোঁজ পাওয়া গেল বাইশ গজে। যখন দ্বিতীয় ওভারে ইকবাল আবদুল্লাকে নিয়ে এলেন নাইট অধিনায়ক। এই সময় নারিন বা সেনানায়কে এলে বার্থডে গিফটের ব্যাপারটা উঠত না। কিন্তু ইকবাল আবদুল্লার আগমন বোঝাই গেল তেন্ডুলকরের ওপর প্রবল মানসিক চাপ রাখতে। ইদানীং যে তিনি বাঁ-হাতি স্পিনার ভাল খেলছেন না।
লোকগাথা বলে, ব্র্যাডম্যান তাঁর জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংসে হোলিসের গুগলি বুঝতে পারেননি। আবেগ তাঁর মনের বিন্যাসকে অন্যমনস্ক করে রাখায়। সচিন— তিনিও কি চালসের দুনিয়ায় পা দেওয়ার দিনে ভালবাসার স্তূপে নিজের মনকে চাপা পড়া আবিষ্কার করলেন? বহু বছর আগে পি সেন ট্রফি খেলার সময় এই মাঠে ওপেন করতে নেমেছিলেন বন্ধু অতুল রানাডের সঙ্গে। কয়েক বল খেলার পর রানাডেকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “কী রকম বুঝছিস?” রানাডে বলেন, “বেশ টেনশন হচ্ছে। এই একটা স্থানীয় ম্যাচেও দেখছি কুড়ি হাজার লোক এসেছে।” সচিন হেসে বলেছিলেন, “এই লোক দেখেই ঘাবড়ে গেলি? আমরা যখন এখানে টেস্ট ম্যাচ খেলি এক লাখ লোক দেখতে আসে। মানে দু’লাখ চোখের সামনে খেলতে হয়।” বিশ্বকাপ-উত্তর ইডেনের নবতম সংস্করণে দর্শকসংখ্যা এখন সাতষট্টি হাজার। তা এ দিন ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করেও এমন খচাখচ ভর্তি ছিল যে, সচিন নিশ্চয়ই পরে হিসেব করবেন ক্রিকেটজীবনের সায়াহ্নেও কলকাতা মাঠে পরীক্ষা দিলেন এক লাখ চৌত্রিশ হাজার চোখের সামনে।
পরীক্ষা দিলেন এবং মর্মান্তিক ব্যর্থ হলেন। টসের আগে দেখা গেল ক্লাবহাউস প্রান্তের উইকেটের সামনে শ্যাডো করছেন। এটা সম্পূর্ণ স্বভাববিরুদ্ধ। এ ভাবে শ্যাডো করেন রাহুল দ্রাবিড়। করতেন ম্যাথু হেডেন। আজ কি তা হলে চল্লিশ বছরে পড়া চ্যাম্পিয়ন বিশেষ কিছু করে দেখাতে অসম্ভব ব্যাকুল? গোটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বিশ্ব যে রক্ষণশীল ইংল্যান্ড-সহ সমাদরে পালন করছে তাঁর জন্মদিন। তাদের একটা যোগ্য রিটার্ন গিফট দিতে হবে না?
প্রথম বল যখন খেলছেন, সমুদ্রগর্জনের মতো ইডেন তাঁর হয়ে প্রার্থনা করছিল। এমন দোআঁশলা দর্শক ইডেনের ইতিহাসে কখনও হয়েছে কি না সন্দেহ। যেখানে সচিন আউট হওয়ার আগে অবধি ক্রমাগত গুলিয়ে গেছে হাততালিটা কাদের জন্য পড়ছে? এ দিন খেলা তাঁর প্রথম ডেলিভারিতেই এলবিডব্লিউ-র জোরালো আবেদন উঠেছিল। অনেকটা সামনে খেলায় আম্পায়ার ধর্মসেনা ছাড় দেন। বার্থডে বয় কী করে বার্থডে বয়কে আউট দেন!
কয়েক ওভার পরে অবশ্য যেটা ঘটল তা ধর্মসেনারও সীমান্তের বাইরে। নারিনের সামনে হুমড়ি খেয়ে বোল্ড। ব্যাট আর প্যাডের মধ্যে যা দূরত্ব, সেটাকেই নিশ্চিহ্ন করার জন্য তেন্ডুলকরের এত বছরের ক্রিকেট সাধনা। আদ্যিকালের ডব্লিউ জি গ্রেস হলে ধর্মসেনার দিকে কটমট করে বলতে পারতেন, শোনো লোকে তোমার আম্পায়ারিং দেখতে আসেনি। বলে শান্ত মনে বেল দুটো আবার উইকেটের ওপর সাজিয়ে দিতেন। এখন প্রযুক্তির যুগ। বিজ্ঞানের যুগ। এ সব রোম্যান্টিসিজম স্বপ্নেও কেউ দেখে না। সুতরাং রাত সাড়ে দশটা নাগাদ মাঠে ঢোকা তেন্ডুলকর তেরো মিনিটের বিরতিতে ফের ঢুকে গেলেন ড্রেসিংরুমের ছাউনিতে। রেখে গেলেন একটা মর্মস্পর্শী জিজ্ঞাসা।
|
জন্মদিনে ‘ছোটবাবু’র খেলা দেখতে ইডেনে সৌরভ। |
ইডেনকে এটাই তা হলে তাঁর বিদায়ী উপহার? ফেরার সময় ব্যাট না তোলায় আন্দাজ পাওয়া গেল না। যেমন উত্তর পাওয়া গেল না এই প্রশ্নের যে, সচিন বাদ দিয়ে লোকে কি কেকেআরকে অখণ্ড সমর্থন করছিল? নইলে ভারতের সম্ভাব্য হার বুঝলে যেমন লোকে ইডেন থেকে বেরিয়ে যায়, তেমনই একটা ঝাঁক দ্রুত হালকা হয়ে গেল সচিন-বিদায়ের পরপরই। এই ক্যাপ্টিভ অডিয়েন্সের দেখা হল না ম্যান অব দ্য ম্যাচ ডোয়েন স্মিথ (৪৫ বলে ৬২) এর পর যে মারমার শুরু করলেন তাতে ওই উইকেট পতনের কোনও ছায়াপাত ছিল না। আর নারিন বাদ দিয়ে কাউকে খেলতে অসুবিধে হচ্ছে এমন ইঙ্গিতও পোলার্ড বা রোহিতরা দেননি।
মোটামুটি উঁচু পর্যায়ের ফুটবলে যেমন খেলার শুরুতেই মাঝমাঠ দখলের তীব্র লড়াই হয়, পেপসি আইপিএলের এই ম্যাচটাতেও দেখা গেল ক্রমাগত সেটা হচ্ছে। আসলে তালিকায় একটা দল জেনারেল বেড-এ ভর্তি। আর একটা দল আউটডোরে চেক-আপ করাচ্ছে। মুম্বই ইন্ডিয়ান্স, তারা এর আগে তিনটে ম্যাচ হেরেছে। আরও একটা হারলেও তবু ফিরে আসার সুযোগ আছে। কেকেআরের সচিনের কাছে হারা মানে প্রায় আইসিইউ-তে। ছ’টা হার মানে আইপিএলে মোটামুটি গল্প শেষ। এত ম্যাচ বাকি। এখনই পাঁচ নম্বরটা হারতে যে গম্ভীর চাইছেন না, সেটা তাঁর নানাবিধ ফাটকা দেখেই বোঝা গেল। আবদুল্লাকে ব্যবহার করা সচিনের পুলিশম্যান হিসেবে সেটা আগেই লিখলাম। ইউসুফকে ওপেনিংয়ে পাঠানো অব্যাহত রাখলেন। আর মনোজ তিওয়ারিকে আগে পাঠিয়ে দিলেন মর্গ্যানের। সম্ভবত মনোজ স্পিন তুলনামূলক ভাল খেলেন বলে। নইলে এ বছর নাইটদের মোট রানে শতকরা ৫২ ভাগ করেছেন মিলিত ভাবে শুধু গম্ভীর আর মর্গ্যান। দিনের শেষে কিছুই অবশ্য কাজ করল না। রজত ভাটিয়া যখন শেষ ওভার শুরু করছেন, অতিথিদের চাই ৬ বলে ১০ রান। সেই ওভারেইএকটা উইকেট পড়ে যাওয়ায় মনে হচ্ছিল সচিনের জন্মদিনের উৎসব সত্যিই মাটি হয়ে গেল। কিন্তু দিনের প্রথম ওভারের ভিলেন হরভজন সিংহ ম্যাচের শেষ ওভারে নির্ণায়ক হয়ে এগিয়ে এলেন লং অনের ওপর দিয়ে মারা ছক্কায়।
শাহরুখের দল এখন আইসিইউ-তেই নাম লেখানোর পথে। আর একটা হারার শুধু অপেক্ষা। সরি, সেটা ডেথ সার্টিফিকেটের দিকে নিয়ে যাবে।
মাঝরাত্তিরে ইডেন প্রেসবক্সে কপিটা শেষ করতে করতে মনে হচ্ছে শুধু তো সচিনের জন্মদিনের কেক নয়। এই মাঠেই বিজয়োৎসবের কেকটাও কাটা হয়েছিল না? যেখানে মুখ্যমন্ত্রী এসেছিলেন। শাহরুখ নেচেছিলেন, গেয়েছিলেন। চ্যাম্পিয়নরা অবশ্য এখন খাদের ধারে বিষণ্ণতা কুড়োতে ব্যস্ত! তাদের জীবনে আর জাম্পিং ঝপাক নেই!
|