মৃত্যুর কারণ নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। অথচ, বার বার বলা সত্ত্বেও পুলিশ খুনের মামলা দায়ের করেনি বলে অভিযোগ। শেষ পর্যন্ত আদালতের দ্বারস্থ হন মৃত স্কুলছাত্রের বাবা। পুলিশকে খুনের মামলা শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন হুগলির শ্রীরামপুর মহকুমা আদালতের বিচারক। বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন জেলার পুলিশ সুপার।
গত ১ ফেব্রুয়ারি গুড়াপে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে একাদশ শ্রেণির পড়ুয়া বছর সতেরোর সৌনিক চট্টোপাধ্যায় ওরফে কাটু এবং সৌনক ভাণ্ডারীর মৃত্যু হয়। সৌনকের পরিবার থাকে শ্রীরামপুরে। ডানকুনির দক্ষিণ সুভাষপল্লির একটি আবাসনের বাসিন্দা সৌনিক।
তাদের বাড়ির লোক জানান, ঘটনার দিন সকাল ১১টা নাগাদ বন্ধুদের ফোন পেয়ে তারা বাড়ি থেকে বেরোয়। তিনটি মোটরবাইকে চড়ে ছ’জন বন্ধু (তাদের মধ্যে এক জন মেয়ে) গুড়াপে যায়। একটি ধাবায় খাওয়া-দাওয়া করে। পুলিশের বক্তব্য, বিকেলে ফেরার সময় কাটুর বাইকে সে এবং সৌনক ছিল। একটি গাড়ি বাইকটিকে ধাক্কা মারে। দু’জনকে বর্ধমানের একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হলে সেখান থেকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। তত ক্ষণে দু’জনেরই মৃত্যু হয়েছে। |
কলকাতার বালিগঞ্জের সুইনহো স্ট্রিটের বাসিন্দা জনৈক মহেন্দ্র ত্রিখা (পুলিশের কাছে মহেন্দ্রর পরিচয় অজানা গাড়ির চালক) গুড়াপ থানাকে লিখিত ভাবে জানান, পিছন দিক থেকে বেপরোয়া গতিতে একটি ট্রাক এসে বাইকটিকে ধাক্কা মারে। দু’জনে ছিটকে পড়ে। ওই বয়ানের ভিত্তিতেই দুর্ঘটনা-সংক্রান্ত মামলা করে পুলিশ।
যদিও, গোটা ঘটনায় দুর্ঘটনার তত্ত্ব নিয়েই যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে বলে দাবি মৃতের পরিবারের।
ঘটনার পর দিন বর্ধমান মেডিক্যালে দেহ দু’টির ময়না-তদন্ত হয়। ওই রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘দুর্ঘটনা’ কথাটি লেখা হয়নি। বরং ‘কোনও আঘাতের ফলে’ মৃত্যু হয়েছে বলে ময়না-তদন্তকারী চিকিৎসকের মনে হয়েছে। দু’জনেরই মূলত মাথার পিছনে গভীর ক্ষত ছিল। তাদের হেলমেট খুঁজে পাওয়া যায়নি। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের মতো দ্রুতগামী রাস্তায় পিছন থেকে কোনও গাড়ি মোটরবাইকে ধাক্কা মারলে বাইকটির ক্ষতি হওয়ার কথা। যদিও, বাইকে একটি আঁচড়ও লাগেনি। কাটুর মা শাশ্বতী চট্টোপাধ্যায় এবং প্রতিবেশীরা বলেন, “মৃত্যুর কারণ নিয়ে ওদের বন্ধুদের কথায় যথেষ্ট অসঙ্গতি ছিল।” সৌনকের মা কৃষ্ণা ভাণ্ডারীর দাবি, “বন্ধুরা ওদের প্রচণ্ড মারধর করে বলে আমরা জেনেছি। তাতেই ওরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।”
তাঁরা জানান, গোটা বিষয়টি জানিয়ে খুনের মামলা দায়ের করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। অভিযোগ, পুলিশ কর্ণপাত করেনি। বন্ধুরা সঙ্গে থাকতেও কেন কলকাতার বাসিন্দা অজানা গাড়ির চালকের কাছ থেকে বয়ান নেওয়া হল তা-ও পরিস্কার নয়। গুড়াপ থানার অবশ্য দাবি, ওই ব্যক্তি স্থানীয় হোটেলের ম্যানেজার। এফআইআর-এ ভুল করে তাঁকে অজানা গাড়ির চালক বলে লেখা হয়েছে। তাঁর বয়ানের ভিত্তিতেই মামলা দায়ের করা হয়। সৌনকদের বন্ধুদের সকলকে এখনও চিহ্নিত করা যায়নি। প্রাথমিক ভাবে এলাকায় গিয়ে দুর্ঘটনা বলেই মনে হয়েছিল বলেও তদন্তকারীদের দাবি। যদিও, ঘটনার পরে সৌনকদের উত্তরপাড়ার বাড়িতে হুমকি-ফোন আসে বলে অভিযোগ।
এর পরেই সৌনকের বাবা পার্থসারথি ভাণ্ডারী শ্রীরামপুর আদালতের এসিজেএম রতন দাসের কাছে উত্তরপাড়া থানায় নির্দিষ্ট মামলা দায়ের করার আবেদন জানান। আদালত ওই থানাকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। উত্তরপাড়া থানা অবশ্য লিখিত ভাবে আদালতকে জানায়, ঘটনাস্থল গুড়াপ হওয়ায় ওই থানাকেই তদন্তভার দেওয়া হোক। পার্থসারথিবাবুদের আইনজীবী জয়প্রসাদ ভট্টাচার্য জানান, আদালত এ ব্যাপারে পরবর্তী নির্দেশ দিলেই মামলা শুরু হবে। গত বৃহস্পতিবার পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করেন কাটুর বাবা-মা।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) তথাগত বসু বলেন, “সিআই (সদর) বিভাগীয় তদন্ত করছেন। পুলিশের ভূমিকা নিয়েও যে সব প্রশ্ন উঠেছে, তারও পৃথক তদন্ত করছেন তিনি।” |