আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তান পার্লামেন্টের নির্বাচন। সে দেশের ইতিহাসে এই নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই প্রথম একটি নির্বাচিত সরকার পাকিস্তানে তাহার পাঁচ বৎসরের মেয়াদ পূর্ণ করিতে পারিয়াছে, মধ্যপথে কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষী জঙ্গি জেনারেল তাহাকে ক্ষমতাচ্যুত করিতে সচেষ্ট হয় নাই। নির্বাচনী প্রচারেও বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল যে-সব কথা বলিতেছে, তাহাতে এই প্রথম আশ্চর্যজনক ভাবে ভারত-বিরোধী বিষোদ্গার প্রায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। দলীয় ইস্তাহারগুলিতেও সাবেক ‘শত্রুরাষ্ট্র’-র বিরুদ্ধে রণোন্মাদনা নাই। বরং ভারতের সহিত শান্তিপূর্ণ আলোচনা মারফত কাশ্মীর সমস্যা-সহ দ্বিপাক্ষিক বিরোধগুলি আপসে মিটাইয়া ফেলার প্রস্তাবে সব দলেরই সুর এক। শাসক দল পিপল্স পার্টি হইতে শুরু করিয়া বিরোধী দল নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ কিংবা ইমরান খানের ‘তেহরিক-এ-ইনসাফ’ও ইস্তাহারে শান্তি, গণতন্ত্র ও আলোচনার উপর জোর দিয়াছে। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন হইতে অদ্যাবধি, দীর্ঘ সাড়ে ছয় দশকের ইতিহাসে ভারতের প্রতি এ ধরনের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব নিতান্ত বিরল। ইহা সুলক্ষণ।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক-সামাজিক অগ্রাধিকার যে পরিবর্তিত হইতেছে, তাহার লক্ষণগুলি স্পষ্ট। এই পরিবর্তন সম্ভব হইয়াছে সে দেশের সর্বাপেক্ষা সংগঠিত ও শৃঙ্খলাপরায়ণ প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনীর মানসিকতা বদলের ফলেই। সেই পরিবর্তন অহেতুক নয়। পাক জেনারেলরা ক্রমশ আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের ভিতরকার জেহাদি সন্ত্রাস ও তাহার প্রবক্তা তালিবানকে প্রধান বিপদ রূপে শনাক্ত করিতেছেন। এক অর্থে, আগে যে স্থানটি ভারতের জন্য ধার্য ছিল, বর্তমানে তাহা ইসলামি জেহাদের দখলে। দীর্ঘ কাল ধরিয়া এই জেহাদিদের প্রশ্রয় দিবার পর পাক সামরিক বাহিনী সম্ভবত উপলব্ধি করিয়াছে, তালিবান ও অন্যান্য জঙ্গি জেহাদি গোষ্ঠীই দেশের প্রধান শত্রু, ভারত নয়। একই সঙ্গে রাজনীতিকদের ভারতবিরোধী কুৎসা প্রচার এবং কাশ্মীরের ‘স্বাধীনতা’র জন্য নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলনও অনেকটাই স্তিমিত। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক শক্তিবিন্যাস যে চেহারা লইতেছে, সেখানে অদূর ভবিষ্যতে ইহার পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনাও কম। তাই নওয়াজ শরিফের দলীয় ইস্তাহারে যখন আফগানিস্তান ও ইরানের সহিত ভারতের বাণিজ্যিক সেতু হইয়া ওঠার কাজে পাকিস্তানকে নিয়োজিত করার প্রস্তাব থাকে, তাহা অভূতপূর্ব হইলেও অস্বাভাবিক মনে হয় না। শত্রুতার মাত্রা প্রশমিত করিয়া দ্বিপাক্ষিকতার পথে অগ্রসর হইলে যে উভয় দেশেরই লাভ, তাহার উপলব্ধি দৃশ্যত বাড়িতেছে। পাক রাজনীতিকরা এখন ভোটদাতাদের কাছে তাঁহাদের বিগত পাঁচ বছরের কৃতকর্মের খতিয়ান লইয়া হাজির হইতেছেন এবং আগামী পাঁচ বছর কী কী করিতে চাহেন, তাহার ফিরিস্তি দিতেছেন। অর্থাৎ ভারত বা অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে ভাবে নির্বাচনী প্রচার চলে, পাকিস্তানও সেই পন্থাই অনুসরণ করিতেছে। উপমহাদেশের অন্যান্য নবীন গণতন্ত্র কি ইসলামাবাদের এই অভিজ্ঞতা হইতে কিছু শিক্ষা লইতে পারে? বাংলাদেশ এবং অবশ্যই নেপালেও নির্বাচনী প্রচারের লগ্ন সমুপস্থিত হইলেই ভারত-বিরোধী প্রচার শুরু হয়। ভারত উপমহাদেশের বৃহৎশক্তি, সন্দেহ নাই। অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ও দুর্বল প্রতিবেশীরা তাই ভারতের ‘দাদাগিরি’ লইয়া বাস্তব ও কাল্পনিক নানা অভিযোগ লইয়া সর্বদাই কূটনীতির হাওয়া গরম করিয়া থাকে। নেপালের মাওবাদীরা এবং বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার বিএনপি ভারত-বিরোধিতাকে অভ্যাসে পরিণত করিয়াছেন। ইদানীং অবশ্য উভয়ের ক্ষেত্রেই বৃহৎ প্রতিবেশীকে ঠোক্কর মারার জাতীয়তাবাদী অনুশীলনে কিঞ্চিৎ ভাটা পড়িয়াছে। বেগম জিয়া তো বিরোধী নেত্রী হিসাবে ভারত সফরও করিয়া গিয়াছেন। এই সবই শুভ সঙ্কেত। বিশেষত শুভ এই কারণে যে, গণতন্ত্রের অনুশীলনের মধ্য দিয়াই এই পরিবর্তনগুলি ঘটিতেছে। ভারতের কাজ এই প্রক্রিয়াকে সর্বতোভাবে সাহায্য করা। প্রতিবেশী দেশের অনুকূল মনোভাব যদি গণতন্ত্রের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। |