লগ্নিকারীদের হাতে মার খাওয়ার ভয়, অন্য দিকে পুলিশে ধরার আতঙ্ক। সারদা গোষ্ঠীর এজেন্টদের একটা বড় অংশই এলাকায় থাকতে পারছেন না। সিঁদুরে মেঘ দেখছেন আরও বেশ কিছু ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার এজেন্টরা।
ভাল চাকরি ছেড়ে সারদা বা এ রকম কিছু সংস্থার এজেন্ট হওয়ার নমুনা নেই, তা নয়। কিন্তু এজেন্টদের বেশির ভাগই পেট চালানোর মতো চাকরি বা ব্যবসার রাস্তা না পেয়েই এই সব সংস্থার হয়ে লগ্নি তুলতে নেমেছিলেন। অনেকের পরিবারের অবস্থাও বিশেষ ভাল নয়। সংস্থার ভরাডুবি হলে লগ্নিকারীর মতো তাঁরাও পড়েন অগাধ জলে। দুর্গাপুরের মায়াবাজারে ইতিমধ্যে এক এজেন্ট আত্মহত্যাও করেছেন বলে খবর।
কিন্তু সমস্যা হল, সারদার মতো অর্থলগ্নি সংস্থা যে পাড়ায়-পাড়ায় ছড়িয়ে থাকা লক্ষ-লক্ষ মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত মানুষের থেকে টাকা তোলে, তাঁরা সংস্থার প্রতিভূ বলতে ওই এজেন্টদেরই চেনেন। তাঁদের সিংহ ভাগই সুদীপ্ত সেন নামটা হয়তো অনেকেই এই প্রথম বার শুনছেন। ফলে, টাকা মার যাওয়ার ভয়ে তাঁরা প্রথমে এজেন্টদেরই খুঁজছেন। বিশেষত সারদার সব অফিস যখন বন্ধ, লগ্নিকারীদের কাছে এজেন্ট ছাড়া জবাবদিহি করার কেউ নেইও।
কিন্তু এজেন্টদের কাছে কী জবাব আছে? ইতিমধ্যে লগ্নিকারীদের অভিযোগেক ভিত্তিতে সারদার তিন এজেন্ট গ্রেফতার হয়েছেন। তাঁদেরই এক জন বিমলেন্দু কার্ফার কথায়, “সারদা গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরাই প্রথম মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে আন্দোলন করেছি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, পুলিশ আমাদেরই গ্রেফতার করছে। আতঙ্কিত না হয়ে উপায় কী?” বেগতিক দেখে অনেক এজেন্ট এলাকা ছেড়েছেন। নিজের বাড়ি ছেড়ে আত্মীয়বন্ধুদের বাড়িতে চলে গিয়েছেন অনেকে। বেশির ভাগেরই মোবাইল হয় বন্ধ অথবা ফোন ধরছেন না। |
রূপনারায়ণপুরের বাসিন্দা পঞ্চম সিংহ জানান, সারদার যে এজেন্টকে টাকা দিয়েছিলেন তিনি বেপাত্তা। তরুণকুমার দে নামে আর এক লগ্নিকারীর এজেন্ট থাকেন দেশবন্ধু পার্ক এলাকায়। তাঁরও খোঁজ নেই। আসানসোলের ইপ্সিতা মণ্ডল জানান, তাঁর এজেন্টও গায়েব। কল্যাণপুরে রীতিমতো ক্ষমতাশালী বলে পরিচিত ওই এজেন্ট বিপুল টাকা তুলেছিলেন বলে এলাকায় খবর। রামকৃষ্ণ ডাঙ্গাল এলাকার এক এজেন্টকে টাকা দিয়েছিলেন জয়রামজি পটেল। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সপ্তাহখানেক আগে থেকেই তিনি ঘরছাড়া।
রবিবার দুর্গাপুরের রাজীব গাঁধী ময়দানে এজেন্টেরা বৈঠকে বসেছিলেন। সেখানে জানানো হয়, লগ্নিকারী ও এজেন্টদের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই রাজ্যস্তরে এজেন্টদের ৩৫ জনের কোর কমিটি গড়া হয়েছে। কিন্তু পরের দিন থেকেই সেই সব এজেন্টদের অধিকাংশের মোবাইল বন্ধ। বর্ধমানে সারদার এক এজেন্ট নৃপেন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “আমরা বিপদে পড়ে গিয়েছি। লগ্নিকারীরা আমাদের টাকা দিয়েছেন। তাঁরা আমাদের কাছ থেকেই টাকা বুঝে নিতে চাইছেন। সুদীপ্ত সেন ধরা পড়ার খবর পেয়েই আমার মতো অনেকে বাড়ি ছাড়ছেন। এখনও জানি না অবশ্য, শেষরক্ষা হবে কি না।”
অন্য বহু সংস্থার এজেন্টদেরও অনেকে এলাকায় নেই। আসানসোল, রূপনারায়ণপুর, বার্নপুরে একাধিক অর্থলগ্নি সংস্থার দফতর আছে। তাদের বেশির ভাগ এজেন্টই এখন বেপাত্তা। মঙ্গলবার এলাকায় গিয়ে ওই সব সংস্থার একটি অফিসও খোলা পাওয়া যায়নি। দুর্গাপুরে বেনাচিতির ভিড়িঙ্গি মোড়ে একটি সংস্থার অফিসে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েক জন এসেছেন লগ্নি ফেরতের দাবি নিয়ে। মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার ঝুঁকি নিতে তাঁরা নারাজ। জয়দেব রোড এলাকার সোমনাথ অধিকারী বলেন, “যত দিন যাচ্ছে, সংস্থার কর্মীরা কম কথা বলছেন, সন্দেহ তত বাড়ছে।”
দুর্গাপুরেই বেঙ্গল অম্বুজা এলাকায় অন্য এক সংস্থার দফতরে গিয়ে দেখা যায়, কর্মীরা লগ্নিকারীদের বলছেন, “এক দশকেরও বেশি ধরে আমাদের সংস্থা বাজারে রয়েছে। টাকা ফেরত পাননি এমন এক জনও নেই। বৃথা আতঙ্কিত হবেন না।” কিন্তু তাঁদের সে আশ্বাসে তেমন কাজ হচ্ছে না। এমএএমসি এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা শুভেন্দু নাগ বললেন, “ডাকঘর থেকে টাকা তুলে এখানে লগ্নি করেছিলাম। জানি না কী হবে?”
বর্ধমানে টক অফ দ্য টাওয়ারে অফিস, এমন একটি অর্থলগ্নি সংস্থার এজেন্ট দেবাশিস মুখোপাধ্যায় বলেন, “মেয়াদ উত্তীর্ণ লগ্নির টাকা ফেরত দেওয়া গত দু’তিন মাস ধরে বন্ধ ছিল। পরিস্থিতি বুঝে সংস্থার চেয়ারম্যান সেই টাকা দেওয়া শুরু করতে বলেছেন। তাতেও সব দিক রক্ষা হবে বলে মনে হয় না।” অপর এজেন্ট বলরাম পাল বলেন, “এর আগে এজেন্টদের কমিশন দেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখন বলা হয়, প্রত্যেক এজেন্টকে মাসে অন্তত ১০ হাজার টাকার নতুন লগ্নি তুলতেই হবে। তার একটি হবে দীর্ঘমেয়াদী। এ বার এই সঙ্কট থেকে রেহাই মিলবে কী করে?” সংস্থা সূত্রে অবশ্য বলা হয়েছে, এ সব নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।
কিন্তু এজেন্টরা নিশ্চিন্ত হতে পারছেন কোথায়? |