চালশের জঙ্গেল


ভোঁতা হয়েই থেকে যাক উগ্র সমালোচকদের দাঁত-নখগুলো
এবিপি নিউজ-এর সান্ধ্যকালীন ক্রিকেট শো-র মধ্যে তখন বিজ্ঞাপনের বিরতি। লাইভ শোয়ের মধ্যে বিজ্ঞাপনের বিরতি হল একমাত্র সময় যখন দর্শকদের আড়ালে অনুষ্ঠানের অতিথিরা একে অপরের সঙ্গে টকব্যাক-এ কথা বলার সুযোগ পান। ঘণ্টাখানেক আগে কোটলায় অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে টেস্ট ম্যাচ শেষ হয়েছে। ভারত সিরিজ জিতল ৪-০। কিন্ত সচিন আউট মাত্র এক করে। শোয়ের বিষয়, জয়ের মধ্যে সেই হালকা বিষণ্ণতা। সচিন তা হলে শেষ? দিল্লির স্টুডিয়োতে বসে বলার চেষ্টা করছিলাম, এই ছুটকো ব্যর্থতা নিয়ে সচিন সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। যার প্রতিবাদ করছিলেন মুম্বইয়ে বসা বিনোদ কাম্বলি। কমার্শিয়াল ব্রেক হতেই হিসহিসে গলায় কাম্বলি বললেন, “আরও খেলবে? দাদা একটু বলুন তো ওর কি এই রেকর্ডটাও চাইইন্ডিয়ার হয়ে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বয়সে টেস্ট খেলার?” গলায় ঝরে পড়ছে আক্রোশ, বিদ্বেষ এবং পরিহাস। শুনলে কে বলবে এককালে রাম-বলরামের মতো ভারতীয় ক্রিকেটে এই দুটো নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হত। সচিন-কাম্বলি। টকব্যাকে এই সাংবাদিক উত্তর দেওয়ার আগেই দিল্লিতে বসে থাকা আর একটা গলা ভেসে এল। ইনি মনোজ প্রভাকর। ম্যাঞ্চেস্টারে সচিনের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির সময় প্রভাকরই ছিলেন উলটো দিকে। খুব প্রশংসাও করেছিলেন সে দিন। সেটা অবশ্য ছিল ১৯৯০। এটা ২০১৩। এই প্রভাকর উল্লাসের সঙ্গে বললেন, “ওরে বিনোদ, ইন্ডিয়ার হয়ে সব চেয়ে বেশি বয়সে টেস্ট খেলেছে রঞ্জিত সিংহজি। সচিন ওর রেকর্ডটা ভাঙবে।” কাম্বলি এ বার জানতে চান রঞ্জির তখন বয়স কত ছিল? অনুষ্ঠানে বিজ্ঞাপন জগতের এক কেষ্টবিষ্টু ছিলেন। তিনি বলে দিলেন, “পঁয়তাল্লিশ।” কাম্বলি তখন হাসছেন, “তা হলে আরও ছ’বছর খেলবে।” এই প্রথম বলার সুযোগ পেলাম যে, রঞ্জি কখনও ভারতের হয়ে খেলেনইনি আর ওঁর অবসর তিরিশ বছর বয়সে। সামান্য দমে গিয়ে কাম্বলি আবার ভেসে উঠলেন, “তা হলে রেকর্ডটা কার খোঁজ নিন। সেটা নির্ঘাত ও ভাঙবে।” এ বার বিরতি শেষ হয়ে ক্রিকেট শো ফের চালু হয়ে গেল। কিন্তু এই ভাবনাটা থেকেই গেল মনে যে, সচিন তেন্ডুলকরকে আপাত যতই অজাতশত্রু মনে হোক, তাঁর সমালোচক সংখ্যা অন্তরালে বেড়েই চলেছে। আর তারা ছুরিও শানাচ্ছে। সঞ্জয় মঞ্জরেকর আছেন। আজহারউদ্দিন আছেন। আছেন আরও প্রবাদপ্রতিম কেউ কেউ। একটা সময় তেন্ডুলকর বলতেন, “আমার জীবনে সব চেয়ে বড় পাওনা হবে খেলা ছাড়ার পর যদি প্রাক্তনরা বলেন, হ্যাঁ এ সম্মানের সঙ্গে ক্রিকেটজীবনটা কাটিয়েছে।” আপাতত সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা বৃহত্তর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আপামর ভারতবাসীকে সচিন গত চব্বিশ বছর ধরে যে পরিমাণ আনন্দ আর বিনোদন দিয়ে আসছেন, তাতে শেষ দৃশ্যে সমালোচকদের দাঁত-নখগুলো ভোঁতা হয়ে যাওয়া তাঁর প্রাপ্য।


চালশে-জয়ী হিসেবে খ্যাত হোক আপনার নাম
সাহিত্য সহবাসের গাছে
এক দস্যি
ডব্লিউ জি গ্রেস পঞ্চাশ বছর বয়সে টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। কলিন কাউড্রে, ব্রায়ান ক্লোজ-রা চল্লিশোর্ধ্ব বয়সেও ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ফাস্ট বোলারদের মোকাবিলায় অসীম বীরত্ব দেখিয়েছেন। চল্লিশ বছরের সচিনের তা হলে একসেলেন্স অক্ষুণ্ণ রাখায় সমস্যা কোথায়? গর্ডন গ্রিনিজ-গ্রাহাম গুচেরাও একচল্লিশ বছর বয়সে টেস্ট খেলেছেন। স্টিভ ওয় কিছু দিন আগে তো বলেইছেন, “স্পোর্টস মেডিসিনের যুগে প্লেয়ারের অবসর সীমা এখন আরও বিস্তৃত হবে। আরও বেশি বয়সে লোকে খেলা ছাড়বে। কারণ আধুনিক সময়ে সে উন্নততর ফিটনেস রেজিম-এর মধ্যে দিয়ে যায়।” এ সবই ঠিক তবু ওপরের নামগুলো আর সচিনের কেস স্টাডি কখনই এক হতে পারে না। গ্রেসের আমলে ক্রিকেট কোনও ভাবেই তুলনীয় নয়। আর বাকি নামগুলো যতই ভারী ভারী হোক, প্রভাবে এবং মর্যাদায় এঁরা মিলিত ভাবেও সচিন নন। এঁদের চাপটা ছিল নিছকই ব্যক্তিগত মর্যাদাকে বাঁচিয়ে রাখার। সচিনের ক্ষেত্রে বরাবর ব্যক্তি আর দেশ মিলে একাকার হয়ে গিয়েছে। তাঁর একটা ভুল সিদ্ধান্তে শুধুই নিজের গৌরবে কাদাজল নয়, কোথাও দেশের সম্মানহানির দৃষ্টিকোণটাও চলে আসে। একশো কুড়ি কোটির দেশে সীমাহীন অভুতপূর্ব চাপ তাঁর ওপর। গ্রেগ চ্যাপেল অবধি বলেছেন, স্যর ডনকে এর অর্ধেক চাপও নিতে হয়নি। চালশের জঙ্গলে স্বভাবতই সচিনের পরীক্ষা অনেক দুর্গম। এরই মধ্যে কেউ কেউ বলতে শুরু করেছে, চোখের প্রবলেম হয়নি তো? এত বলের লাইন মিস করছে! সেই আদ্যিকালে এর চেয়েও বেশি বয়সে ভারতের হয়ে রান করেছেন বিনু মাঁকড়-বিজয় মার্চেন্ট। সচিনের সুযোগ এসেছে সেই চূড়ান্ত সোপানটাও অতিক্রম করে নিজের নতুন রাজপ্রাসাদ গড়ার। তিনি হয়ে থাকুন আধুনিক সময়ে পৃথিবীর প্রথম স্বীকৃত চালশে-জয়ী।


সমর্থকদের বাকি জীবনও যেন অ্যালজোলাম না লাগে

শিবাজি পার্কে।
যুগের নাম প্রাক সচিন
ইনদওরের এক ভক্ত বহু বছর আগে খুব সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করেছিল সচিন তেন্ডুলকরের মাহাত্ম্য। টিনএজার ছেলেটি সবে এগারো ক্লাসে ঢুকেছে। স্থানীয় পত্রিকা সম্পাদককে লিখেছিল, ‘উনি এমন বিশ্বাসের যে, ভারত ওয়েস্ট ইন্ডিজে খেলুক বা অস্ট্রেলিয়ায়। সেটা গভীর রাত হোক কী ভোররাত। সচিন ক্রিজে থাকলে শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকতে পারি। জানি দেশ নিরাপদে আছে।’ এই অন্ধ বিশ্বাস তেন্ডুলকরের মতো করে আর কোনও ভারতীয় ক্রীড়াবিদ অর্জন করতে পারেননি। বাকি গোটা শতাব্দীতেও পারবেন কি না অনিশ্চিত। ব্যাট হাতে তেন্ডুলকর এমনই অব্যর্থ ট্যাবলেট যে, তার কোনও প্রেসক্রিপশন লাগে না। সেটা কিনতে কোনও ডিসপেনসারিতে যেতে হয় না। অথচ সীমান্তে চব্বিশ ঘণ্টা মোতায়েন থাকা সৈন্যের মতো কোথাও তার দেশবাসীকে অবচেতনে আশ্বস্ত করার একটা ক্ষমতা রয়েছে। ভিভ রিচার্ডস অবসর নেওয়ার পর সখেদে বলেছেন, “ওয়েস্ট ইন্ডিজ যখন মাঠে আক্রান্ত হয়, তখন কখনও কখনও আমার সেই জেনারেলের মতো লাগে যার দেশ রক্তাক্ত দেখেও সে বন্দুকটা তুলতে পারছে না।” সচিনের যেন ব্যাট ছেড়ে দেওয়া অবসর জীবনে নিজেকে কখনও এমন অসহায় না লাগে। সচিন-বড়ির প্রভাব যেন কোথাও কোথাও থেকেই যায়। গোটা দেশে ঘুমের ওষুধের বিক্রি না বাড়িয়ে।


প্রত্যাখ্যান করে যেতেই থাকুন বলিউডকে
সচিন তেন্ডুলকরের ব্যক্তিগত বৃত্ত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে। শুরু হয়েছিল আপাদমস্তক ক্রিকেটারদের দিয়ে। আজ সেখানে ক্রিকেটারের সঙ্গে শিল্পপতি, হোটেলিয়র, চিত্রতারকা, চিত্রশিল্পী। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যাঁরা সচিনকে কখনও না কখনও ফিল্মে দেখতে চান। সচিনের খুব ঘনিষ্ঠ চিত্রপরিচালক বিধু বিনোদ চোপড়া। কমন বন্ধুর মাধ্যমে বিধু বিনোদ প্রচুর চেষ্টাও করেছেন সচিনকে রাজি করানোর। শোনা যায়, স্ক্রিপ্ট অবধি পাঠিয়েছিলেন। অবসর জীবনে ধরেই নেওয়া যায় এ রকম অনেক বিধু বিনোদ হাজির হবেন। আর আশা করা যায়, তাঁরা সবাই প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরবেন। সচিনভক্তরা তাঁকে এত কাল চিনে এসেছেন ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মৌলবাদী হিসেবে। তাঁদের কাছে সচিনের বরাবরের মনোভাব হল, মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক আমি তোমাদেরই লোক! সিনেমায় অভিনয়ের মধ্যে খারাপ কিছু নেই। কপিল-গাওস্করেরা তো করেওছেন। কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন সচিন হলেন সচিন! তিনি অন্য চরিত্রে অভিনয় করছেন। ধরা যাক সেই চরিত্রের নাম রাহুল। আর শু্যটিং চলছে মুম্বইয়ের ফিল্ম সিটিতে তখনকার এক অপরিচিত নায়িকার সঙ্গে। এটা হয়তো সচিনভক্ত ফিল্মের লোকেরাও চাইবেন না। সচিন যে বরাবর বাস্তব পৃথিবীর অবিসংবাদী প্রতিনিধি। যেখানে এক বলের ভুলে সব কিছু ছারখার। সারা জীবন বাস্তবের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরি করার পর একই মানুষটা রি-টেকের তাঁবেদারি করবে কোন দুঃখে?


উদ্দাম আইপিএল হাওয়ায় বটগাছ হয়ে শোভা পাক আপনার কর্মসংস্কৃতি
ইডেন বুধবার সচিনকে শেষ বারের মতো দেখবে? নাকি আরও একটা আইপিএল খেলবেন? সচিন নিজেও এর উত্তর জানেন না। অবশ্য উত্তরটা যত না গুরুত্বের তার চেয়ে ঢের তাৎপর্যপূর্ণ হল তেন্ডুলকর কর্মসংস্কৃতি। যা আইপিএলের উদ্দাম নাচো গাও জিও জীবনযাত্রার মধ্যে বটগাছ সদৃশ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেই ঝড়কে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। এত বছর আইপিএল খেলছেন। কখনও কোনও আফটার ম্যাচ পার্টিতে কেউ তাঁকে পাঁচ মিনিটের বেশি পায়নি। কখনও মুম্বই মার্কা বলিউডি প্রমোদে তাঁকে কেউ গা ভাসাতে দেখেনি। নৈশ ম্যাচ খেলেও পরের দিন সকালে এয়ারপোর্ট যাওয়ার সময় নিজের জন্য আলাদা গাড়ি দাবি করেননি। টিমবাসে ওঠার জন্য দেরি করে কখনও এক টাকা ফাইন দেননি। দেরিই যে হয়নি তাঁর। সোজা বাংলায় ক্রিকেটের সঙ্গে কখনও বিরুদ্ধাচার করেননি।

সেনাধ্যক্ষ তাঁর অস্ত্রসহ
গত ক্রিসমাসেই তো! বড়দিনের বাজারে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের নেটে দেখা নেই। মেলবোর্নে নিখাদ ছুটি ছুটি ভাব। যথেষ্ট ক্রিকেটকর্মীরই দেখা নেই। এদিকে সচিনের গোটা পরিবার মেলবোর্নের হোটেলে হাজির। ভারতীয় টিভি সাংবাদিকেরা যথারীতি জল্পনায় ব্যস্ত। আজ অর্জুন-সারাকে নিয়ে এখানে জায়ান্ট হুইলে যাবে। শট লাগবে। কেউ বললেন, না, মেলবোর্ন জু-তে যাবে। যাঁকে নিয়ে এত আলোচনা, তাঁকে অবশ্য টানা পাওয়া গেল নেটে। তিন ঘণ্টা বাদে যখন বেরোচ্ছেন, জিজ্ঞেস করলাম, আজ এতক্ষণ নেট? সচিন তাকালেন, “আজ একটু কম হয়ে গেল।” এই অমানুষিক কর্মসংস্কৃতি কাছ থেকে দেখার বরাত শুধু মুম্বই ইন্ডিয়ান্স পাবে এটা অন্যায্য। আইপিএল জীবন শেষ করার পর ভারতীয় বোর্ড কর্তাদের উচিত, তাঁকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজিতে পাঠানো।
যাতে ভারতের উদভ্রান্ত সব যুব প্রতিভা যারা আইপিএলের টাকা দিয়ে জমি কিনবে না বাড়ি কিনবে, না সোনা কিনবে ভেবে পায় না। তারা কাছ থেকে তেন্ডুলকরের মনন চাখার সুযোগ পায়। আর বোঝে সবচেয়ে লোভনীয় লগ্নি একটাই! সুদ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাবে অন্য একটা স্কিমে। এই লোকটা যেমন পেয়েছে। সেই স্কিমের নাম বাইশ গজ!


জ্বলন্ত থাক একই সঙ্গে দেশসেবা এবং ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের মশাল
ব্র্যাডম্যান আজও অস্ট্রেলিয়ান অবসেশন কেন এই প্রশ্নের মুখোমুখি বারবার হন অস্ট্রেলীয় সমাজবিজ্ঞানীরা। লোকে তাঁদের জিজ্ঞেস করে, তৃতীয় বিশ্বে এই পর্যায়ের কোনও অ্যাচিভারকে ঘিরে দীর্ঘকালীন মাতামাতি ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া তো ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড। খেলাধুলোয় তাদের অনেক অলিম্পিক সোনা আছে। উইম্বলডন চ্যাম্পিয়নশিপ মেডেল আছে। অস্ট্রেলিয়ান রুলস ফুটবলের হিরোরা আছে। ১৯৪৮ সালে অবসর নেওয়া একটা মানুষ ঘিরে আজও এ ধরনের আবেগ কেন? উত্তরে অজি সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, “ব্র্যাডম্যান অস্ট্রেলিয়াকে এমন একটা সময় নির্ভরতা দিয়েছিলেন যখন গোটা দেশ গভীর অর্থনৈতিক অবসাদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গ্রেট ডিপ্রেশনের মধ্যে সাফল্যই ব্র্যাডম্যানকে আজও জীবন্ত দেশসেবক করে রেখেছে।” কিন্তু সেটা ব্র্যাডম্যানের অজান্তে। তিনি ব্যাট করেছেন নিজের এবং টিমের জন্য। আলাদা করে দেশবাসীর জন্য নয়! সচিন দেশসেবক হয়েছেন সচেতন সিদ্ধান্তে। হেলমেটে জাতীয় পতাকাশোভিত তিনি সব সময় দুটো বাইশ গজে পাশাপাশি ব্যাট করেছেন। একটা নিজের জন্য! একটা দেশের জন্য! আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেকে আস্ত রাখাটাই সীমাহীন চাপ। এর ওপর একশো কুড়ি কোটির জন্য ব্যাট করাটা তাকে অমানুষিক পর্যায়ে উত্তীর্ণ করায়।

স্বপ্ন হাতে গেটওয়ে অব ইন্ডিয়ার সামনে
চব্বিশ বছর ধরে এই চাপ নিয়ে চলেছেন সচিন। তাঁর একটা শূন্য যে ঝুমরিতলাইয়া থেকে রামেশ্বরম সর্বাত্মক অবসাদে দেশকে ডুবিয়ে দিতে পারে। তাঁর একটা সেঞ্চুরি যে শ্রীনগর থেকে কোচি অদৃশ্য হোলিতে রাঙিয়ে দিতে পারে তিনি বরাবর জেনে এসেছেন। তাই বাবার মৃত্যুর পরেও শ্রাদ্ধশান্তি মুলতবি রেখে অশৌচের মধ্যেই নেমে যান দেশের হয়ে খেলতে। সেঞ্চুরি শেষ করে আকাশের দিকে মুখ তুলে কোথাও নিজের বাবাকে খোঁজেন। ঠিক সেই মুহূর্তে দেশের সেনাধ্যক্ষ আর ক্রিকেটার মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সবাই ভাল খেললে দেশের জন্য কৃতিত্ব আসে। তিনি দ্রাবিড় হন। কী সৌরভ। কী কুম্বলে। কী ধোনি। নিজের নিজের দিনে এঁরা অসম্ভব কৃতি এবং দেশের গৌরব বাড়িয়ে এসেছেন। কিন্তু সচিনের মতো করে তার বাইরেও বরাবর একটা বৃহত্তর সমাজকে তাঁদের জবাবদিহি করতে হয়নি। সচিন যেন জেনে এসেছেন তাঁর ওপর অসম্ভব আবেগের লগ্নিকারীদের দায়িত্বহীনের মতো ছেড়ে দিয়ে তিনি ভুঁইফোড় চিটফান্ড হতে পারেন না। বরং তিনি এক অতীব সম্ভ্রান্ত প্রতিষ্ঠান। যার শেয়ারহোল্ডাররা তাঁর কাছে ধারাবাহিক লভ্যাংশ আশা করে থাকে। সেই দায়িত্ববোধ যেন অবসরজীবনেও তিনি বিস্মৃত না হন। একইসঙ্গে জ্বলতে থাক তাঁর তৈরি করা দু’টো আগুনের শিখা। যাকে ভবিষ্যত আখ্যা দেবে অমরজ্যোতি।


বহমান থাক জীবনবোধ—ট্যালেন্ট নিয়ে থামতে নেই
সত্তরের দশকে বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের প্রবর্তিত জীবনবোধে পরবর্তী দশকের বাঙালি সাহিত্যসমাজ তো বটেই, স্থানীয় মিডিয়ার একাংশও আচ্ছন্ন থেকেছে। যার সারমর্ম হল: তুমি যদি প্রতিভাবান হও তা হলে বোহেমিয়ান হওয়ার লাইসেন্সও তোমাকে সমাজ দিয়ে দিল। তখন তুমি রাতবিরেতে বেলেল্লাপনা করেও পার পাওয়ার চেষ্টা করতে পারো এই বলে যে, আমি তো প্রতিভাবান! প্রতিভা মানেই আমার দায়িত্বের কোনও ব্যাপার নেই। বরং প্রতিভাবান যদি মাতাল হয়েও বলে, ‘মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করে চার যুবক,’ তা হলে সেটাই দস্তুর। সেটাই ফ্যাশন আর চূড়ান্ত অনুকরণযোগ্য। ভারতীয় ক্রিকেটেও তো সত্তরের দশকে সেই রোম্যান্টিসিজমের রমরমা। রাত্তির দুটোয় গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে এক চুমুকে শেষ পেগ নিঃশেষ করে পটৌডি একটা কাগজ টানলেন। এগিয়ে দিলেন সহ-পানকারী সাংবাদিকের দিকে। কাগজে লেখা ‘চন্দ্রশেখর’। পরের দিন গোপন তুরুপের তাস চন্দ্রই ইডেনে উড়িয়ে দিলেন লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে।

ঈশ্বরের পদস্পর্শ
সচিন সম্পূর্ণ অন্য স্রোতের। তিনি দায়িত্বপূর্ণ রোম্যান্স তৈরি করেছেন। দায়িত্বহীন রোম্যান্সকে অনুসরণ করেননি। আজও ট্র্যাফিক সিগন্যাল অমান্য করেন না। মদ-সিগারেটের বিজ্ঞাপন করেন না। ক্রিকেট সিরিজের মধ্যে কোনও পণ্যের বিজ্ঞাপনে নিজেকে জড়ান না। তাতে যতই স্পনসর চটে যাক আর নিজের আর্থিক ক্ষতি হোক। আজও প্র্যাকটিসে ঢোকা সবার আগে। বার হওয়া সবার পরে। ধোনি কী সাধে বলেছেন, “ক্রিকেট যদি রামচন্দ্র হয়, সচিন তা হলে হনুমান। রামের সবচেয়ে বড় সেবক।” নিজের জিনিয়াসকে কখনও নিজের ধর্মের আগে বসাননি সচিন। তাঁর দর্শন হল, আপামর প্রতিযোগীর জন্য যা নিয়ম, চূড়ান্ত প্রতিভাবানের জন্যও তাই। নিজের প্যাশনকে অনন্ত ভালবাসা যদি মৌলবাদ হয়, সচিন হলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্রিকেট মৌলবাদী। সবচেয়ে বড় জিনিয়াস হয়েও! ঘনিষ্ঠরা চাইবেন, অক্ষুণ্ণ থেকে যাক এমন মৌলবাদী দর্শন।


অক্ষত থাক প্যাশনের সঙ্গে শর্টকাট না নেওয়া
সচিন এমন একজন মানুষ যিনি কোনও কিছুতেই শর্টকাটে বিশ্বাসী নন। শুধু ক্রিকেট নয়, জীবনের যে কোনও ক্ষেত্রে। একবার শ্রীলঙ্কা টেস্ট ম্যাচের আগের সকালে এই সাংবাদিকের সঙ্গে ঘণ্টাদুয়েক বসেছিলেন ‘আনন্দ’ থেকে প্রকাশিত যোগেন চৌধুরীর একটা মোটা বই সঙ্গে নিয়ে। ওই গোটা বইটা উলটেপালটে সচিন নিজের নতুন বাড়ির ড্রইংরুমের জন্য পেন্টিংয়ের পছন্দসই রং বাছছিলেন। আঁকবেন যোগেনবাবুই। কিন্তু সচিন বিনম্র ভাবে বলতে চান, কোন রংগুলো ছবিতে থাকলে ভাল হয়। এর পর শুরু হল, অত মোটা বইটা নিয়ে রীতিমতো ধস্তাধস্তি। বসার ঘরে ঠিক কোন রংটা তাঁর জীবনদর্শনের যোগ্য প্রতিনিধিত্ব করে তার অনুশীলন। সচিনের নেট প্র্যাকটিসের মতোই সেটা এত দীর্ঘস্থায়ী যে প্রত্যক্ষদর্শীকেও তীব্র স্ট্যামিনার পরীক্ষা দিতে হল। কোন রংটা তাঁর সঙ্গে যায়। কোনটা একটু মনমরা হয়ে যায়। তাঁর ক্রিকেট স্টাইলের মতো উজ্জ্বল দেখায় না। এ সব নিয়ে এত নিবিড় বাছাবাছি যে, এর পর যখন সচিনের প্র্যাকটিসে যাওয়ার ডাক পড়ল, তখন দুঃখিত হয়ে দেখলাম পরের দিনের ম্যাচ নিয়ে একটাও কোট নেওয়ার সুযোগ পাইনি। আরও একবার আমেরিকার ন্যাশভিলে ‘সচ’ বইটার রিলিজ অনুষ্ঠান। সচিনের থাকার প্রশ্ন নেই। তিনি একটা দশ-বারো লাইনের বিবৃতি দেবেন। কী বলবেন সেটা ফোনে ঠিক হল।

টিম ইন্ডিয়া জিতেছে। তাই আজ পার্টি হতেই পারে
প্রথম ড্রাফটে এরকম ছিল, ‘বাংলা বলার অভ্যেসটা নিয়মিত ছিল সৌরভ খেলার সময়। অনেক সময় মজা করে মাঝ উইকেটে আমরা বাংলায় কথা বলতাম। সেই বাংলায় আমার ওপর বই হচ্ছে আর সেটা আমেরিকায় রিলিজ হচ্ছে জেনে আমি খুব খুশি।’ সচিন তখন কলম্বোতে। এ বার ড্রাফ্টটা মেল-এ চাইলেন। এখানে বলে রাখা দরকার, ওটা ছিল বই প্রকাশের মধ্যে নিছকই একটা মেসেজ। দীর্ঘস্থায়ী কোনও প্রচারে ব্যবহার হবে না। শ’তিনেক লোক শুনবে আর হয়তো দ্রুতই ভুলে যাবে। কিন্তু সচিন ডিটেলসের মানুষ। ফোনে বললেন, “সৌরভের ওই জায়গাটা রাখা উচিত কি না ভাবছি। একটু অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে না?” দু’দিন বাদে এসএমএস করলেন, ‘ওই লাইনদু’টো দরকার নেই।’ পরে জানলাম কলম্বো থেকে মেল-টা ফরোয়ার্ড করেছিলেন লন্ডনে থাকা অঞ্জলিকে। স্বামী-স্ত্রী মিলে অনেক ভেবেটেবে ওই দুটো লাইন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন দরকার নেই। সচিন যেন এমন চির খুঁতখুঁতেই থেকে যান।


অটুট থাক ভাবমূর্তির আকাশরেখা
হ্যান্সি ক্রোনিয়ে মামলায় যিনি বিচারপতি ছিলেন সেই জাস্টিস কিং একবার আনন্দবাজারকে বলেছিলেন, “তেন্ডুলকরকে আমি ডনের চেয়েও বেশি সম্মান করব যদি উনি প্রকাশ্যে বলেন ম্যাচ ফিক্সিংয়ের ব্যাপারে ওঁর কেমন মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা।” আড়ালে আবডালে অনেকেরই অনুযোগ, সচিন কেন ম্যাচ গড়াপেটার সব গোপন কাহিনি মিডিয়ায় ফাঁস করে দেননি? সচিনের ঘনিষ্ঠ শিবিরের বক্তব্য, তিনি ক্রিকেটার। সংস্কারক নন। পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব কর্তাদের। অর্থাৎ যাঁরা ক্রিকেট প্রশাসক। সচিনের কাজ সারা জীবন সৎ ভাবে খেলে খেলাটার ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করা। ক্রিকেট একসেলেন্সের প্রসার ঘটানো। চোর ধরা তাঁর প্রাথমিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তাই মিডিয়ায় এই নিয়ে মুখ খোলা বা হইচই বাধানোর মধ্যে তিনি নেই। কিন্তু অলক্ষ্যে আছেন সব সময়ইসিরিয়াস তদন্তে সাহায্যকারী হিসেবে।

নতুন জীবনে নতুন সহকর্মীরা
শোনা যায়, সিবিআই-এর ম্যাচ গড়াপেটা নিয়ে তদন্তের সময় গোপন সাক্ষ্যে আজহারউদ্দিন সম্পর্কে সন্দেহজনক কী কী দেখেছেন সব বিস্তারিত বলেছিলেন সচিন। শোনা যায়, আজহারের যে কঠোর শাস্তি হয়েছিল তার একটা বড় কারণ যদি কিছু বুকির সঙ্গে যোগাযোগের অকাট্য প্রমাণ হয়। আর একটা কারণ ছিল সচিনের সাক্ষ্য। সচিন বলছেন মানে অ্যাডিলেডে হরভজন মামলা হোক কী দিল্লিতে সিবিআইসবচেয়ে গুরুত্ব পাবেই। এমনই তাঁর ভাবমূর্তির আকাশরেখা। নিউইয়র্কে গেলে সেখানকার লোকেরা সোৎসাহে দেখান ম্যানহাটনের বিখ্যাত স্কাইলাইন। ভারতে সচিন নিজেই এক অবিশ্বাস্য স্কাইলাইন! মৃত বা জীবিত যাঁরাই সেই সচিন স্কাইলাইন প্রত্যক্ষ করে থাকুন, তাঁদের একান্ত বাসনা হল দেশের গর্বের এই মিনারটা অটুট থাক। যাতে বিদেশি আগন্তুক এলে তাকে ঘুরিয়ে দেখানো যায়, ওই যে সচিন স্কাইলাইন! দেখছেন তো!

১০
আসীন থাকুন রোম্যান্সের রাজপুত্রের সোনার সিংহাসনে
আমেরিকায় একটা কথা খুব চালু আছেদ্য গ্রেট আমেরিকান ড্রিম। একই জীবনে ব্যক্তির তুঙ্গস্পর্শী সাফল্য, সামাজিক জীবনে শৃঙ্গ থেকে শৃঙ্গান্তরে উত্থান। যাঁকে অবশ্যই হতে হবে আমেরিকাবাসী। সচিন তেন্ডুলকর হলেন সেই আমেরিকান ড্রিমের ভারতীয় উত্তর। এক প্রজন্মের কোটি কোটিপতি। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবেশ থেকে উঠে এসে কোনও রকম সুপারিশ ছাড়া দীর্ঘ এত বছর নিজের খ্যাতি এবং কৃতিত্বকে এই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, এটা শুধুই গ্রেট অ্যাচিভারের কাহিনি নয়। এ সব ছাপিয়ে স্বপ্নের রামধনু আকাশে বিস্তৃত করে দেওয়া। যাকে সময় সময় মনে হতে পারে, সত্যি দেখছি না ইলিউশন? সত্যি একটা ষোলো বছরের ছেলে নাকে বল লেগে রক্তাক্ত হওয়ার পর পরের ডেলিভারিটাই দাঁড়িয়ে উঠে চার মারছে ভয়ঙ্কর ফাস্ট বোলারকে? সত্যি বিশ্বের এক নম্বর স্পিনারকে মারা চার নম্বর ছক্কায় ড্রেসিংরুমের কাচের জানলা ভেঙে দিচ্ছে? বাবা মারা যাওয়ার পরের ম্যাচেই সেঞ্চুরি করে দিচ্ছে?

মাঠের বাইরেও দেশসেবক
চল্লিশ বছরেও সিঙ্গলস নিচ্ছে চোদ্দো বছরের গতিতে? সচিন তাই যুগ থেকে যুগে হস্তান্তরিত এক বহমান রূপকথা। প্রধানমন্ত্রী বদলেছে। রাষ্ট্রপতি বদলেছে। বিচারপতি বদলেছে। বার্লিন প্রাচীর ভেঙেছে। কমিউনিজম আক্রান্ত হয়েছে। বিদেশি মুদ্রার বাজার অবিরাম ওঠানামা প্রত্যক্ষ করেছে। নতুন প্রযুক্তি এসেছে। আইটি নামক একটা পেশার রমরমা হয়েছে। তিনি সচিনযাবতীয় বদলের মধ্যে থেকে গিয়েছেন অবিনশ্বর। যেন এক চলমান অশরীরী। হতাশা আর সংশয়ের মধ্যে তাঁর ব্যাট বরাবর বয়ে এনেছে আলো। শেষ এপ্রিলের কলকাতাতেও চিটফান্ড আর দুর্নীতি, আমানতকারীদের দুর্দশা নিয়ে চ্যানেলে-কাগজে অন্তহীন নৈরাশ্যজনক আলোচনার মধ্যে চল্লিশ বছরের জন্মদিনে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন মুক্তির আশ্বাস হিসেবে। আমার মুক্তি সচিনের ব্যাটের আলোয়! -য়ের শুভেচ্ছা, রোম্যান্সের রাজসিংহাসন যেন তাঁর দখলেই থেকে যায়। বালকবীরের রূপকথা শুরু হয়েছিল জঙ্গি প্রতিপক্ষ দেশে। চালশের জঙ্গলে শেষ দৃশ্যে পর্দা পড়ুক—ডারবানে ডেল স্টেইন পিটিয়ে সেঞ্চুরির পর!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.