সাইকেল চড়ে পার্বতী। পেছনে বসে বিড়ি টানতে টানতে চলেছেন শিব ঠাকুর।
৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে বছর পাঁচেক আগেও এটা ছিল প্রথম গ্রীষ্মের চেনা ছবি। চৈত্রের শেষ থেকে বৈশাখের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রায়ই চোখে পড়ত। কিন্তু সময় বড় দ্রুত পাল্টায়। বোলানই হারিয়ে যাচ্ছে, সেই সব শিব-পার্বতীরা আর কোথায়?
বোলান কী? বোলান হল মূলত চৈত্র-সংক্রান্তির সময়ে শিব বা ধর্মঠাকুরকে যাঁরা পুজো করেন, সেই সব ভক্ত বা সন্ন্যাসীর মনোরঞ্জনের জন্য রচিত দেবদেবীর মাহাত্ম্য-গান। এতে মূলত ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনিই বর্ণিত হত।
কিন্তু বর্তমানে তার আঙ্গিক বদলেছে। আজকাল এতে সামাজিক পালাই বেশি দেখা যায়। যাত্রাদলের মতোই এতেও দর্শকদের টানতে বোলান শিল্পীরা সামাজিক, দৈনন্দিন কাহিনিই বেছে নিচ্ছেন। আধুনিক যন্ত্রসংগীতও তালিকার বাইরে থাকত। অভিনেতারা পায়ে হেঁটে কিংবা সাইকেল বা গরুর গাড়িতে চেপেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করতেন। কিন্তু তাঁরা এখন গাড়িই ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া, পুরুষরাই আগে নারী সেজে অভিনয় করতেন। এখন মহিলারাও পুরুষদের সঙ্গে চুটিয়ে অভিনয় করছেন। অনেক সময় বোলান দলে অস্থায়ী কাঠের পাটাতন ও আলোর ব্যবহারও করা হচ্ছে। |
চলছে পালা। বেলডাঙায় তোলা নিজস্ব চিত্র। |
প্রাক্তন শিক্ষক অনাদিকুমার মণ্ডল বলেন, “যাত্রায় পেশাদার শিল্পীদের প্রত্যক্ষ করা যায়। তার সঙ্গে উন্নত মঞ্চসজ্জা, জোরালো আলো, অত্যাধুনিক যন্ত্রসংগীতের ব্যবহার কিংবা অভিনেতাদের সুকণ্ঠ ইত্যাদি থাকে। অন্য দিকে বোলানে মঞ্চ চারিদিকে খোলা, শিল্পীরা অপেশাদার, আলোর ব্যবহার কম, কণ্ঠস্বর মধুর নয় ইত্যাদি। তবে দুটি আঙ্গিকেই কিছু মিলও দেখা যাচ্ছে এখন। যেমন দুটি ক্ষেত্রেই সামাজিক পালার চল বেশি এবং মানুষকে আদর্শ, শিক্ষা শেখানোর তাগিদ লক্ষ করা যায়।
বেলডাঙা শ্রীসচন্দ্র উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও লোকসংস্কৃতির আলোচক বলরাম হালদার বলেন, “অতীতে বোলান গানে নল-দময়ন্তী, শিববন্দনা, গণেশবন্দনা লক্ষ করা যেত। আজকের দিনে সামাজিক পালাই বেশি। হারমোনিয়াম, তবলা, খোল,খঞ্জনি, বাঁশির স্থানে এসেছে আধুনিক বাদ্যযন্ত্র। মানুষের জীবন-জীবিকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচি মেনে যাত্রাগানের কাহিনিই বোলানের মূল আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। প্রাচীন বোলানের পালাকারদের মৃত্যুর পর পালার কাহিনির অভাব থেকেই বাজার-চলতি যাত্রাগানের বইগুলি তাঁদের কাহিনির একমাত্র সূত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বর্তমানের বোলান গান যাত্রার অনুররূপ মনে হতেই পারে। দূরদর্শনের জনপ্রিয় সিরিয়ালের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে তাই এই পরিবর্তনই মানুষকে কাছে টানার উদ্যোগ।”
রাঢ়ভূমিই বোলান গানের আদিভূমি বলে দাবি করেন শক্তিপুর কে এম সি ইনস্টিটিউটের ইংরেজির শিক্ষক ও বোলান গানের গবেষক প্রদীপনারায়ণ রায়। তিনি বলেন, “বোলানের নামকরণের কথা বলতে গেলে, ‘বোল’ বা ডাক-দেবীকে আহ্বান থেকেই ‘বোলান’ নামের উত্পত্তি। অবশ্য কেউ একে ‘বুলান’-ও বলেন‘বুলা’ অর্থাত্ ঘুরে ঘুরে এর প্রদর্শন দেখানো। তা থেকেই এমন একটি শব্দের আগমন বলে মনে করেন অনেকে। তা ছাড়া কেউ আবার মনে করেন, গাজন-সন্ন্যাসীদের প্রধানকে যেহেতু ‘বালা’ অভিহিত করা হয়, তাই তাঁদের উদ্দেশে গীত গানকেও ‘বোলান গান’ বলা হয়ে থাকে।” তিনি জানান, অতীতের ‘তরণীসেন বধ’, ‘মহিরাবণ বধ’ বা ‘চণ্ডাল হরিশ্চন্দ্র’র জায়গায় এখন এসেছে সামাজিক আত্মত্যাগের পালা ‘বড় ভাই’ ‘বউ কেমন আছ’ ইত্যাদি নামে। মানুষ এখন সমসাময়িক পালাই মন দিয়ে শোনে, তাই যাত্রার পালাই তাদের বেশি আকর্ষণ করে। একই ভাবে হারমোনিয়ামের স্থান নিয়েছে সিন্থেসাইজার। ফলে বোলান অনেকটাই যাত্রা হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বড় কথা, মহিলারাও যাত্রার মতোই এখন এতে অংশ নিচ্ছেন, যা অতীতে ছিল অত্যন্তই বিরল।” হারানো বোলান তবুও চলছে খুঁড়িয়ে। |