সারদা গোষ্ঠীর ভরাডুবির খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন অন্য অর্থলগ্নি সংস্থার আমানতকারীরাও। শুক্র এবং শনিবার সারদা গোষ্ঠীর আমানতকারীদের রাজ্য জুড়ে বিক্ষোভ, সংস্থার দফতরে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে চলার পরেও, সংস্থার তরফে বা সরকারের তরফেও ভরসার করার মতো কোনও আশ্বাস মেলেনি। এই ঘটনা দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে অন্য আমানতকারীদেরও।
রবিবার সাধারণত বন্ধ থাকলেও এজেন্ট এবং আমানতকারীদের চাপে অফিস খুলতে বাধ্য হয় শিলিগুড়ির চার্চ রোডের একটি অর্থলগ্নি সংস্থা। এ দিন সকাল থেকেই ওই অফিসের সামনে ভিড় বাড়তে থাকে। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে বছর পঁচিশের এক যুবক মোবাইলে ফোন করে সংস্থার এক কর্তাকে অফিস আসার জন্য ধমকাতে থাকেন। ফোনে কথা বলার পরেই কান্নায় ভেঙে পড়েন শিলিগুড়ির হাকিমপাড়া এলাকার বাসিন্দা যুবকটি। উস্কোখুস্কো চুল, চোখের নিচে কালি পড়া চেহারা নিয়ে তিনি বললেন, “দয়া করে নাম লিখবেন না। আরও বদনাম হয়ে যাব। শিলিগুড়ি কলেজ থেকে স্নাতক হয়েছি। ভাল কমিশন দিচ্ছে শুনে দেড় বছর আগে সংস্থার এজেন্ট হই। শিলিগুড়ি আর মাটিগাড়া মিলে ২০০ জন আমানতকারীর ৮ লক্ষ টাকা জমা রেখেছি। সারদার ঘটনার পরে দু’রাত ঘুমোতে পারিনি। সকলে বাড়ি আসছে। মা-বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এখন এই সংস্থার কর্তারাও বলছে সামনের মাস থেকে টাকা দেবে। কী করব জানি না। বাবা-মাকে রেখে মরতেও পারব না।”
তবে চার্চ রোডের সংস্থাটি অবশ্য এদিন দুপুরে অফিস খোলে। অফিসে উপচে পড়ে এজেন্ট ও আমানতকারীর ভিড়। প্রায় ঘণ্টা খানেক দফায় দফায় বৈঠকের পরে এজেন্ট, আমানতকারীরা ফিরে গেলেও তাদের আশঙ্কা রয়েই গিয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আমানতকারীদের প্রতি মাসে সুদ দেওয়া বন্ধ করেছে সংস্থাটি। সঞ্চয়ের মেয়াদ পূর্ণ হলেও টাকা দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ। এ দিন অফিস খোলার পরে সংস্থার কর্তারা এসে এজেন্টদের এক মাস অপেক্ষা করতে বললে ক্ষোভে ফেটে পড়েন এজেন্টরা। সংস্থার টেবিল চাপড়ে এক এজেন্ট বলেন, “পরিবারে সকলে ভীত সন্ত্রস্ত। সারদার ঘটনার পরে আমানতকারীরা বাড়িতে এসে হুমকি দিচ্ছে। যত দিন টাকা দেবেন না তত দিন কী আপনারা আমাদের বাড়ি এসে থাকবেন, নাকি আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবেন?”
রাজগঞ্জের বাসিন্দা এজেন্ট চৈতন্য দাস বলেন, “বলছে তো মে মাস থেকে টাকা দেবে। সেই কথা কী আর আমানতকারীরা শুনবে। দেখা যাক কী করি। প্রতি দিন অফিসে এসে একবার করে দেখে যেতে হবে।” সংস্থায় টাকা লগ্নি করেছেন শিলিগুড়ির শান্তিনগর এলাকার বাসিন্দা বিমল দেবনাথ। তিনি অবশ্য সারদা গোষ্ঠীতেও টাকা রেখেছিলেন। এ দিন তিনি বলেন, “সারদার টাকা তো গেল। এই সংস্থার টাকাও চলে গেলে বেশি দিন সুস্থ থাকতে পারব কি না তাই প্রশ্ন।’’
সংস্থাটি সূত্রে অবশ্য দাবি করা হয়েছে, তাদের কাছে গচ্ছিত আমানত সুরক্ষিত রয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে সংস্থার কর্ণধারের মৃত্যুর পরে, তাঁর স্ত্রীর নামে কাগজপত্র তৈরিতে কিছুটা সময় লাগছে। আগামী মাসের মধ্যে নথি তৈরির পরে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া শুরু হবে।
রায়গঞ্জেও বেশ কয়েকটি অর্থলগ্নি সংস্থার অফিস রয়েছে। উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগমের রায়গঞ্জ ডিপোর এক কর্মী প্রণব বসাক বলেন, “ডিপোর কর্মীর একাংশ-সহ রায়গঞ্জের কলেজ পাড়া ও বীরনগর এলাকার প্রচুর মানুষ অতিরিক্ত লাভের আশায় বিভিন্ন মেয়াদে টাকা জমা রেখেছেন। সারদা গোষ্ঠীর অফিস বন্ধ হওয়ার পর থেকে প্রত্যেকে চিন্তায় আছে। ডিপোর অনেক কর্মী এখন টাকা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।” কোচবিহারে সারদা গোষ্ঠী ছাড়া জেলার ৪৫টি অর্থলগ্নিকারী সংস্থার অফিস আছে। জেলা প্রশাসনের তরফে একটি তালিকাও তৈরি করা হয়েছে। সংস্থাগুলির দফতর খোলা রয়েছে। আমানতকারীরা টাকা তুলে নেওয়ার জন্য ভিড় করতে শুরু করেছেন। জেলাশাসক মোহন গাঁধী বলেন, “সব খতিয়ে দেখে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।” প্রশাসনের কাছে অভিযোগ পৌঁছেছে, একটি সংস্থা এক সপ্তাহ ধরে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিচ্ছে না। গত দু’মাস ধরে টাকা দেওয়া বন্ধ রেখেছে জলপাইগুড়ির বাবুপাড়ার একটি অর্থলগ্নি সংস্থাও। মণ্ডলঘাট এলাকার এক বাসিন্দার কথায়, “চলতি মাসে মেয়ের বিয়ে রয়েছে। বছর দেড়েক আগে মেয়ের বিয়ের জন্য প্রায় ১ লক্ষ টাকা রেখেছিলাম। ওরা বলেছিল টাকা দ্বিগুণ হবে। দু’মাস ধরে অফিসে এসে ঘুরে যাচ্ছি। টাকা পাচ্ছি না। অফিস বন্ধ হয়ে গেলে মেয়ের কাছে মুখ দেখাব কী করে।” একই অবস্থা জলপাইগুড়ির কামরপাড়ার এক সংস্থারও। যদিও ওই সংস্থার তরফে দাবি করা হয়েছে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে টাকা পাওয়া যাবে।
মালদহ জেলায় সারদা বাদে আরও একশোর বেশি অর্থলগ্নি সংস্থা রয়েছে। যেগুলির সঙ্গে ২০ হাজারেরও বেশি এজেন্ট রয়েছে। বালুরঘাট শহরে ১৫ থেকে ২০টি ভুঁইফোড় অর্থলগ্নি সংস্থা টাকা তোলার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। সারদার ঘটনার পর ওই সংস্থায় টাকা জমা রাখা আমানতকারীরা আতঙ্কে। সংস্থাগুলির সেবির অনুমোদন আছে কি না তা খতিয়ে দেখছে প্রশাসন। |