লাভের অঙ্ক যে আকাশছোঁয়া! তাই আর সাত-পাঁচ ভাবেননি। সাত বছরে দশ গুণ ফেরতের আশায় সর্বস্ব ঢেলে দিয়েছিলেন সারদার গহ্বরে। অর্থনীতির কোনও নিয়মেই যে এটা সম্ভব নয়, তা মাথায় আসেনি দিন-আনি-দিন-খাই পরিবারের প্রায় নিরক্ষর প্রৌঢ়ার।
|
ঊর্মিলা |
এবং স্বপ্নেও ভাবেননি, বহু বছরের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের টাকা এ ভাবে হারাবেন। সংস্থা লাটে ওঠার খবর পেয়ে পাগলের মতো এ দিক-ও দিক ছুটেছেন। ঘিঞ্জি বস্তির একচিলতে ঘরের দেওয়ালে মাথা ঠুকেছেন দিন-রাত। শেষমেশ রবিবার ভোরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরের সেই ঘুপচি ঘরে দাউদাউ আগুনে পুড়ে মারা গেলেন বছর পঞ্চাশের ঊর্মিলা প্রামাণিক। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, গায়ে কেরোসিন ঢেলে তিনি আত্মঘাতী হয়েছেন। সুবুদ্ধিপুরে কেমিক্যাল মাঠের দাসপাড়ার ওই বস্তির বাসিন্দারাও বলছেন, “বহু কষ্টে জমানো টাকা খুইয়েই উনি গায়ে আগুন দিলেন।” শুক্রবার রাতে জেলার ডায়মন্ড হারবারে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন সারদা গোষ্ঠীর এক এজেন্টও।স্থানীয় সূত্রের খবর: বাড়ি বাড়ি পরিচারিকার কাজ করতেন ঊর্মিলাদেবী। স্বামীর মৃত্যুর পরে দাসপাড়ার বস্তিতে আধা কাঠা জমিতে ছোট্ট দু’টো ঘর তুলেছিলেন। ছেলে ভোলাবাবু ভ্যান চালান। পুত্রবধূ সন্ধ্যাদেবী এ দিন দুপুরে বলেন, তাঁর শাশুড়ি অনেক দিন ধরে অল্প অল্প টাকা জমিয়েছিলেন। তা দিয়ে ২০১০-এ ‘সারদা রিয়েলটি ইন্ডিয়া লিমিটেড’-এ দশ হাজার টাকা করে তিনটে ফিক্সড ডিপোজিট করেন। সন্ধ্যাদেবীর দাবি, এজেন্ট তাঁর শাশুড়িকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ‘সারদা গার্ডেন ল্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট’ প্রকল্পে টাকা রাখা হবে। আর সাত বছর বাদে প্রতিটি ডিপোজিট থেকে মিলবে ১ লক্ষ টাকা!
মানে বছরে ১২৫%-এরও বেশি সুদ! যেখানে মেয়াদি আমানতে ব্যাঙ্কে সুদ মেলে বড়জোর ৯%-৯.৫%। কোন জাদুতে এত ফেরত? |
প্রতিশ্রুতির অবাস্তব অঙ্ক ঊর্মিলাদেবীকে নাড়া দেয়নি। দেখেছিলেন শুধু প্রতিশ্রুতির ফাঁপানো ফানুসটা। তার টানেই পা দিয়েছিলেন লগ্নির ফাঁদে, গ্রামে-গঞ্জের আরও হাজারো খেটে খাওয়া মানুষের মতো। ফানুস ফেটে যেতেই যাঁদের মাথায় বজ্রপাত হয়েছে। তবে ‘বিনা মেঘে’ নয়। “বিপর্যয়ের সঙ্কেত তো গোড়াতেই ছিল। অর্থনীতির কোনও যুক্তিতেই যে আমানতে এই বিপুল সুদ দেওয়া সম্ভব নয়, সেটা ওঁরা ধরতে পারেননি। ওঁদের যা বোঝানো হয়েছে, তা-ই বুঝেছেন। এখন মাথা চাপড়ানো ছাড়া কিছু করার নেই।” আক্ষেপ রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তার।
ঊর্মিলাদেবীরও ছিল না। সন্ধ্যাদেবীর কথায়, “টাকা ফেরত পেতে এখানে-ওখানে ছুটেছেন। সালেপুরে গিয়েছেন এজেন্টের কাছে। উনি আশ্বাস দিয়েছিলেন। পরে মা জানতে পারেন, ওঁকে ঠকানো হয়েছে।” পুত্রবধূ জানান, দু’দিন যাবৎ ঊর্মিলাদেবী কার্যত খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। দেওয়ালে মাথা ঠুকতেন, আর ছেলেকে বলতেন, “জীবনে সুখের মুখ দেখিনি। তোর জন্য রেখেছিলাম টাকাটা। সেটা ফেরত দিল না! আমি অ্যাসিড খেয়ে মরব।”
ঊর্মিলাদেবী মরলেন ঠিকই। তবে অ্যাসিডে নয়। পরিজনেরা জানাচ্ছেন, এ দিন ভোরে প্রৌঢ়ার আর্ত চিৎকারে সকলের ঘুম ভেঙে যায়। দেখা যায়, স্নানঘরে দাউদাউ আগুনে জ্বলছেন ঊর্মিলাদেবী। গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় তাঁকে প্রথমে বারুইপুর হাসপাতাল, পরে চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়। সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ তাঁর মৃত্যু হয়।
বারুইপুরে ঊর্মিলাদেবীর গ্রামে দেড়শো-দু’শো পরিবারের অনেকেই টাকা ঢেলেছেন সারদার সংস্থায়। রাখি পাল, বিশাখা সর্দার, বিশ্বজিৎ নস্করদের কেউ হারিয়েছেন কয়েক লক্ষ, কেউ বা হাজার দশেক। হতদরিদ্র মানুষগুলোর সামনে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। সারদা-কাণ্ডের আঁচ লেগেছে ভুঁইফোঁড় অন্যান্য অর্থলগ্নি সংস্থার গায়েও। সাম্প্রতিক পরিস্থিতির আবহে রাজ্য জুড়ে এই জাতীয় সংস্থার উপরে আমজনতার আস্থা চুরমার হতে বসেছে। জমি-বাড়ি থেকে সংবাদমাধ্যম বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘শিল্প-সাম্রাজ্য’ গড়তে উচ্চাকাঙ্ক্ষী বড় গোষ্ঠী থেকে শুরু করে অজ্ঞাতকুলশীল সংস্থাও লগ্নিকারীদের ক্ষোভের লক্ষ্য।
বস্তুত ‘ভুঁইফোঁড়ে বিপর্যয়ের’ ইঙ্গিত মিলেছিল সারদা-কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার ক’দিন আগেই। কিন্তু তা চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। তাই গত ১১ এপ্রিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগরের কেদারপুর গ্রামে সীতারাম মণ্ডলের (৪৭) অপমৃত্যুর কারণ খুঁজে না-পেয়ে অনেকে অবাক হয়েছিলেন। এখন জানা যাচ্ছে, সীতারামবাবু এমনই এক সংস্থার এজেন্ট ছিলেন। তিনি কীটনাশক খেয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন বলে পুলিশের প্রাথমিক অনুমান। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, বিভিন্ন লোকের থেকে তিনি ২৪ লক্ষ টাকা তুলেছিলেন। রুদ্রনগরের সংস্থাটি দু’মাস আগে ঝাঁপ গোটায়। সীতারামবাবুর স্ত্রী চন্দনাদেবীর দাবি, আমানতকারীদের টাকা ফেরাতে পারবেন না বুঝেই তাঁর স্বামী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।
পুলিশের তথ্য, এর সপ্তাহখানেক বাদে দুর্গাপুরে সারদা গোষ্ঠীর এক এজেন্ট আত্মঘাতী হন। আর শুক্রবার রাতে ডায়মন্ড হারবারের কালীনগরে কীটনাশক খান সারদা-এজেন্ট লক্ষ্মণ ঘড়ুই। স্থানীয় ও পারিবারিক-সূত্রের খবর, গত পাঁচ বছরে তিনি প্রায় ২০ লক্ষ টাকা সংস্থায় জমা দিয়েছিলেন।
মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত আমানতকারী থেকে শুরু করে এজেন্ট--- দু’পক্ষের মধ্যেই এখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-আশঙ্কার চেহারাটা প্রকট। যেমন পাইকপাড়ার এক মহিলা। পেশায় গৃহপরিচারিকা। মাসে মাসে ‘এজেন্ট দাদাকে’ আড়াইশো টাকা জমা দিয়ে আসছিলেন। পাঁচ বছর বাদে ২৬ হাজার টাকা পাওয়ার কথা, তিন বছর পেরিয়েছে। কোন ম্যাজিকে এত চড়া সুদ আসে, তা কখনও ভেবে দেখেননি। এখন রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারছেন না। হরিনাভির খবরের কাগজ বিক্রেতা এক তরুণ আবার ‘বেশি লোভের’র জন্য নিজেকে দুষছেন। ভুঁইফোঁড় লগ্নি সংস্থায় মাসিক একশো টাকার প্রকল্পে মোটা ‘দাঁও’ মারার পরে মাসে-মাসে ৫০০ টাকার প্রকল্পে হাত দিয়েছেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ের বিধুভূষণ দে-ও হাত কামড়াচ্ছেন। বাড়ি-গাড়ির মালিক হতে ‘টিভিআই এক্সপ্রেস’-এর চেন-মার্কেটিংয়ে নাম লিখিয়েছিলেন। সংস্থার কর্তা তরুণ ত্রিখা সম্প্রতি জালিয়াতির অভিযোগে ধরা পড়েছেন। তত দিনে সব খুইয়েছেন বিধুভূষণ।
জলপাইগুড়ির মণ্ডলঘাটের সব্জি-বিক্রেতা থেকে বারুইপুরের বিউটি পার্লারকর্মী তরুণী এমন অনেক অখ্যাত চরিত্রই এখন একই নৌকোর যাত্রী। কেউ মেয়ের বিয়ের জন্য জমানো টাকা চৌপাট হওয়ার ভয়ে কাঁটা, কোনও কৃষকের সারা জীবনের সঞ্চয় বেহাত হওয়ার দশা। দমদম ক্যান্টনমেন্টের এক পুলিশ কনস্টেবলও দিশেহারা। পরিচিত এজেন্ট এসে মাসে-মাসে নিয়ম করে হাজার টাকা করে নিয়ে যান তাঁর কাছ থেকে। এ মাসে এজেন্টের দেখা নেই, মোবাইলেও অধরা। টাকা ঢালার আগে কেন যাচাই করে নেননি? এত সুদ কি কেউ দিতে পারে?
ওঁদের প্রায় সকলেরই বক্তব্য: ব্যাঙ্কে নিয়ম-কানুন বিস্তর, ফেরত কম। টাকা জমা দেওয়ার হ্যাপাও বিস্তর। এখানে এজেন্টই বাড়ি বয়ে এসে টাকা নিয়ে যাবে, ফেরত মিলবে হাতে-নাতে এবং অনেক বেশি পরিমাণে। কাজেই এটাই তাঁদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল, যার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে। তার মাসুল দিচ্ছে অন্য সংস্থারাও। দক্ষিণ কলকাতার এক অর্থলগ্নি সংস্থার কর্ণধার অসীম মৈত্র অবশ্য গ্রাহকদের উৎকণ্ঠার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। বছর পাঁচেক ধরে অর্থলগ্নির কারবারে অভিজ্ঞ সংস্থাটির চায়ের ব্যবসাও রয়েছে। অসীমবাবুর আশ্বাস, “আমাদের গ্রাহকদের আমানত পুরোটাই সুরক্ষিত। কিন্তু সারদা-কাণ্ডের পরে অনেককেই বার বার ব্যাপারটা বোঝাতে হচ্ছে।” |