চাই আইনি কবচ
তালাকে খোরপোশ নেই, স্বামীর মৃত্যু কাড়ে ঠাঁই
বিবাহ-বিচ্ছেদ হয় দেশের আইন মেনে। আর মুসলিম সমাজে তালাক হওয়ার কথা শরিয়তের বিধানে।
কিন্তু গ্রামে-গ্রামে তালাকের নামে যা চলছে, তা আসলে এক রকমের রাহাজানি। অসহায় মহিলাদের সম্পত্তি ও সব রকমের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ফিকির। মুর্শিদাবাদের গ্রামে-গ্রামে ফরিদা-রহিমাদের অভিজ্ঞতা অন্তত তেমনই বলছে।
শরিয়ত তথা ইসলামী রীতি মেনে জীবনযাপনের জন্য নিরন্তর প্রচার চালান যাঁরা, সেই জামাত-এ ইসলামি হিন্দের আমির-এ হালকা (সভাপতি) মহম্মদ নুরউদ্দিন বলেন, “যদি তিন তালাক বলা হয়ে যায়, তা হলে স্ত্রী স্বামীর থেকে পাকাপাকি ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। তখনই কিন্তু স্বামীকে দেনমোহরের (কন্যাপণ) পুরো টাকা মিটিয়ে দিতে হবে।”
‘কন্যাপণ’ অর্থে কনে আনার জন্য তার পরিবারকে বরপক্ষ যে অর্থ দেয়। কিন্তু এখন কার্যক্ষেত্রে তা প্রায় উঠেই গিয়েছে। বরং উল্টে বরপণ হিসেবে ঘড়ি, সাইকেল, নগদ টাকা নেওয়ারই চল হয়েছে বাংলার গ্রামে-গ্রামে। কাজেই তালাকের পরে ‘দেনমোহর’ মিটিয়ে দেওয়ার প্রশ্ন আসে না। আইন মোতাবেক বিবাহ-বিচ্ছেদে খোরপোশ পেতে পারেন বধূ। কিন্তু তালাকের ক্ষেত্রে খোরপোশ দেওয়া দূরে থাক, সন্তানের দায়িত্বটুকুও নিতে রাজি হন না বহু স্বামী। নিঃসম্বল মা-কেই খেয়ে না-খেয়ে সন্তানদের বড় করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়।
শুধু কি তালাক?
শ্বশুর বেঁচে থাকতে স্বামী মারা গেলেও সম্পত্তির অধিকার হারান স্ত্রী। মৃত স্বামীকে কবর দেওয়ার পরে সেই রাতেই রানিনগর ব্লকের কোমনগর গ্রামের ফরিদাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন তাঁর শ্বশুর। সাত বছরের ঘর-সংসার ফেলে তিনি মেয়ের হাত ধরে পথে নামেন। একই বিধানে ছেলেমেয়ের হাত ধরে ভিটে ছাড়তে হয়েছে রানিনগরের রহিমা বেওয়াকেও। নওদাপাড়ার তালাক-পাওয়া মাঝবয়সী মহিলা ফরিদার কথায়, “কী ঘিন্নার নিয়ম বলেন দিকি! এই সব মেয়েদেরই ভিন রাজ্যে কাজ দেওয়ার নামে পাচার করে দিচ্ছে। তারা আর ফিরছে না।”
সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, মেয়ে পাচারে মুর্শিদাবাদ সামনের সারিতে। কোণঠাসা হয়ে পড়া এই সব মেয়েদের একটা বড় অংশই এখন তালাক এবং সম্পত্তির অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে আইনি রক্ষাকবচ চাইছেন। বঞ্চনার কথা সরকারের কানে তুলতে তাঁরা গড়েছেন রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতি। সমিতির কর্ণধার খাদিজা বানু বলেন, “মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া, ডোমকল, রানিনগর, ইসলামপুর, জলঙ্গি ও বেলডাঙার একশো গ্রামে সমীক্ষা চালিয়ে আমরা প্রতিটিতে গড়ে অন্তত ২০ জন করে তালাকপ্রাপ্ত মহিলার দেখা পেয়েছি।”
শাহবাজপুরের তালাক পাওয়া মেয়ে সাবিনার দাবি, তাঁর গ্রামে প্রতি পাঁচটি বাড়ির তিনটিতে অন্তত এক জন তালাক পাওয়া মেয়ে রয়েছেন। তাঁর আক্ষেপ, “জেলায় লাখ-লাখ তালাকপ্রাপ্ত মেয়ে। সরকার ইমাম-মুয়াজ্জিনদের ভাতা দিতে পারে আর আমাদের জন্য কিছু করতে পারে না?” রাজ্যের সংখ্যালঘু উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী, তৃণমূলের গিয়াসুদ্দিন মোল্লা আশ্বাস দেন, “ওঁদের কোনও আইনি বা আর্থিক সহায়তা দেওয়া যায় কি না, দেখছি।” যদিও কেমন হতে পারে সেই ‘সহায়তা’, তার কোনও স্পষ্ট হদিস তিনি দেননি।
নারী উন্নয়ন সমিতির হিসেবে, তালাকপ্রাপ্ত মহিলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি মুর্শিদাবাদের ডোমকল। কিন্তু রাজনীতি বড় বালাই। মন্ত্রী যেমন ধোঁয়াটে আশ্বাস দেন, ডোমকলের সিপিএম বিধায়ক তথা প্রাক্তন মন্ত্রী আনিসুর রহমান আবার দাবি করেন, “তালাক অনেক কমেছে। অনেকেই আদালতে যাচ্ছেন।” অথচ সেখানে জামাত-এ ইসলামি হিন্দের নেতা, মুর্শিদাবাদেরই গোলাম মুস্তাফা স্পষ্ট বলছেন, “সমস্যাটা ব্যাপক আকার নিয়েছে। আলেম সমাজের মধ্যে ঐক্য নেই। মুফতিরা টাকার বিনিময়ে ইচ্ছে মতো ফতোয়া দিয়ে দেয়। সেই জন্যই বে-শরিয়তি তালাক সম্ভব হচ্ছে।”
দেশের আইন কিন্তু বলছে, এই দুর্দশা থেকে অনেকটাই পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। ‘সোসাইটি ফর উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট’ সংগঠনের সভাপতি তথা প্রাক্তন বিচারপতি মলয় সেনগুপ্ত বলেন, “তালাক পাওয়া মহিলারা খোরপোশ দাবি করে আদালতে যেতে পারেন। সুপ্রিম কোর্টের এক নির্দেশের পরে খোরপোশ পাওয়া আইনত সহজ হয়েছে। থানা অভিযোগ না নিলে রেজিস্ট্রি ডাকে পুলিশের বড়কর্তার কাছে অভিযোগ পাঠাতে পারেন বা সরাসরি আদালতে জানাতে পারেন।”
রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতি অবশ্য মনে করছে, শরিয়তের নামে যথেচ্ছাচার বন্ধ করার এক মাত্র উপায় ধর্মীয় বিধান সরিয়ে রেখে সকলের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা। খাদিজা মনে করিয়ে দেন, বহু মুসলিম রাষ্ট্রই শরিয়ত সংশোধন করে সকলের জন্য আইন প্রণয়ন করেছে। তাঁর প্রশ্ন, “বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া বা তিউনিশিয়ার মতো মুসলিম রাষ্ট্রেও যদি দেশের আইনে তালাক, বহুবিবাহ ও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত যাবতীয় বিবাদের নিষ্পত্তি হয়, এই ধর্মনিরপেক্ষ দেশের আইনেই বা তা হবে না কেন?”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.