সুখের আশায় ছাই
সর্বহারা হয়ে গেলাম, হা-হুতাশ গ্রাহকদের
দিন কয়েকের না-কাচা পাঞ্জাবি। পাজামার হাঁটুর কাছটা ছিঁড়ে গিয়েছে। একটা চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পড়লেন ভদ্রলোক।
তাঁর হাত কয়েক দূরে বহরমপুর বাস স্ট্যান্ডের লাগোয়া সারদা রিয়েলটি ইন্ডিয়া লিমিটেডের অফিসে তখন একে একে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে এলইডি স্ক্রিন, সুসজ্জিত রিসেপশন ডেস্ক, কাচের গোল টেবিল। তাঁর পুরু কাঁচের চশমা উজিয়ে অনুকূল দাসের দৃষ্টিতে অবশ্য এ সব কিছুই ধরা পড়ছে না। ভদ্রলোক শুধু বিড় বিড় করে চলেছেন, “দেড় লক্ষ টাকা জমিয়েছিলাম। ওটাই আমার সব। ফেরত পাব তো?”
বহরমপুরের বানজেটিয়ার বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব অনুকূলবাবু অবশ্য একা নন। শীতলখুচি থেকে সোদপুর, বসিরহাট থেকে বালুরঘাটরাজ্যের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা, অর্থলগ্নি সংস্থা সারদা গোষ্ঠীর বিভিন্ন বন্ধ কার্যালয়ের দরজায় শনিবার সকাল থেকে প্রশ্নটা ধাক্কা খাচ্ছে। কোথাও সেই বন্ধ দরজা জনরোষে ভেঙে গিয়ে তছনছ হয়েছে। কোথাও বা তার বাইরেই সকাল থেকে হা পিত্যেশ করে বসে থেকেছেন গ্রাহকেরা। সেই তালিকায় প্রবীণ অনুকূলবাবুর মতো রয়েছেন খেটে খাওয়া গিয়াসুদ্দিন আসগর’রাও। নদিয়ার সীমান্ত এলাকা তেহট্টের ওই প্রৌঢ় বলেন, “কুড়ি টাকা করে রোজ এজেন্টের হাতে তুলে দিতাম। দু-বছর পরে ২৫ হাজার টাকা পাব। এমনই জানতাম।” সেই ভরসায় বুক বেঁধে মেয়ের জন্য পাত্রও দেখতে শুরু করেছিলেন গিয়াসুদ্দিন। সীমান্তের সেই ভ্যানচালকের আক্ষেপ, “সর্বহারা হয়ে গেলাম জানেন!”
মুর্শিদাবাদে সারদার অফিসে বিক্ষোভকারীদের ভাঙচুর। শনিবার। ছবি: গৌতম প্রামাণিক
‘সর্বহারা’দের এই দীর্ঘ তালিকায় রয়েছেন সারদা গোষ্ঠীর এক গাড়ি চালকও। বালুরঘাটে সারদার অফিসেই গাড়ি চালাতেন মহাদেব ঘোষ। এ দিন অফিসে এসে দেখেন তালা ঝুলছে। কেঁদে ফেলেন মহাদেব। বলেন, “বাড়ি বিক্রির ২ লক্ষ টাকা সংস্থায় জমা রেখেছিলাম। আগামী বছর প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা পাওয়ার কথা ছিল। আমারও এই হাল হল!”
সাধারণ আমানতকারীদের পাশাপাশি স্বস্তিতে নেই অগুন্তি এজেন্ট-ও। ইতিমধ্যেই তাঁদের অনেকেই পরিচিত পড়শিদের হেনস্থার শিকার। অনেকেই আবার পাল্টা ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন ভুঁইফোড় ওই অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে। তাঁদেরই এক জন বহরমপুরের মুক্তি হালদার বলেন, “সারদার লোভনীয় প্রস্তাবে অনেকেই ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে সারদায় জমা দিয়েছেন। আমি নিজেও দিয়েছিলাম। এখন আমার আত্মহত্যা ছাড়া আর কী করার আছে বলুন। কর্তাদের এখনই গ্রেফতার করা উচিৎ।”
তবে, নদিয়ার করিমপুরের এক এজেন্ট বলছেন, ‘‘কেউ কিছু বলার আগেই আমি আমানতকারীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝাচ্ছি, ভয়ের কিছু নেই। মুখ্যমন্ত্রী যখন আশ্বাস দিয়েছেন তখন নিশ্চয় একটা ব্যবস্থা হবে।’’ কিন্তু তাতে কি চিঁড়ে ভিজছে?
উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁয় সারদার প্রায় দু’হাজার এজেন্ট রয়েছেন। তাঁদের পক্ষে বাবুসোনা পালচৌধুরী শনিবার স্থানীয় থানায় পুলিশি নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেছেন। তিনি বলেন, “আমার মাধ্যমে সারদা গোষ্ঠীতে বিভিন্ন আমানতকারীদের এক কোটি টাকার ডিপোজিট করা হয়েছে। গ্রাহকেরা আমায় ছেড়ে দেবেন? আমার জীবনহানির আশঙ্কা রয়েছে।” তাঁরা এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিও পাঠিয়েছেন। বহরমপুরের এজেন্ট বলরাম কাণ্ডারি অবশ্য জানান, এপ্রিল নয়, টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে না গত ডিসেম্বর থেকে। তিনি বলেন, “আমার অধীনে রয়েছে ১৫০ জন এজেন্ট। এজেন্টদের মাধ্যমে আমানতকারীদের রেকারিং ডিপোজিট, ফিক্সড ডিপোজিট ও মান্থলি ইনকাম স্কিম মিলিয়ে মোট আড়াই কোটি টাকা সংগ্রহ করে সারদার অফিসে জমা দিয়েছি। কিন্তু ডিসেম্বর থেকেই টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে না।”
কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের নিরাপত্তা সত্ত্বেও গ্রাম-শহরের মানুষ ওই ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলিতে এমন মুক্তকচ্ছ হয়ে টাকা জমা দিয়েছেন কোন ভরসায়?
বসিরহাটের টাকি রোডে থাকেন বেসরকারি এক জাহাজ সংস্থার অবসরপ্রাপ্ত কর্মী নিমর্লকুমার রায় ও তার স্ত্রী ভারতীদেবী। চাকরি শেষে যে টাকা পেয়েছিলেন তা খরচ হয়েছিল মেয়ের বিয়ে ও বাড়ি তৈরিতে। সামান্য টাকায় সংসার চালানোর ফাঁকে আচমকাই তাঁরা ওই অর্থলগ্নি সংস্থার লোভনীয় প্রস্তাব পান। ২০০৯ সালের অগস্টে পঞ্চাশ হাজার টাকা এমআইএস করেন তিনি। পরে ২০১২ সালে নিজের নামে আরও এক লাখ টাকা রাখেন। কেন, নিছকই লোভ? নির্মলবাবু বলেন, “ওই সংস্থায় শাসক দলের অনেক নেতা জড়িত। অনেকেই ভরসা জুগিয়েছিলেন, টাকা মার যাওয়ার ভয় নেই। তাই টাকা দিয়েছিলাম।”
ভারতীদেবী বলেন, “স্বামীর অসুখের চিকিৎসা ও সংসার কীভাবে চালাব জানি না।” নবদ্বীপের লটারির টিকিট বিক্রেতা মহাদেব পাল, কার্তিক কুন্ডুরা দৈনিক দশ টাকা করে পনেরো মাসের জন্য টাকা জমা দিচ্ছিলেন। মহাদেববাবুর লগ্নির মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু টাকা পাননি। হতাশ মহাদেববাবু বলেন, ‘‘ব্যাঙ্কের জটিলতা নেই। এজেন্টরাই এসে টাকা নিয়ে যেত। ভাবলাম অসুবিধা হবে না। টাকাটা পেলে নাতির অন্নপ্রাশন করব ভেবেছিলাম। সে আর হল না।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.