নববর্ষের জমাটি আড্ডার কথা ভোলেনি রাজবাড়ি
ঠারো শতকের একেবারে শেষ পর্ব। নববর্ষের সকালে জমাট আড্ডা বসেছে নদিয়া রাজবাড়িতে। কে নেই সেই আড্ডায়? রয়েছেন তৎকালীন নদিয়ারাজ মহারাজ ক্ষীতীশচন্দ্র। এসেছেন রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ রামতনু লাহিড়ির মধ্যম সন্তান শরৎ কুমার। এবং এসেছেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির উজ্জ্বল নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নববর্ষের সকালে কবিগুরু গাইছেন তাঁর স্বরচিত গান। মুগ্ধ হয়ে শুনছেন শ্রোতারা। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের নজরে পড়ল ঘরের এককোণে যত্নে সাজানো একটি বাঁশি। কবিগুরু জানতে চাইলেন, “বাঁশি বাজে না কেন?” রাজবাড়ির সদস্যরা নিশ্চূপ। ক্ষীতীশচন্দ্রের হয়ে উত্তর দিলেন শরৎকুমার, “বাজাতে জানলে তবেই বাঁশি বাজে।” প্রসঙ্গ আর না বাড়িয়ে আবার গাইতে শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ।
নববর্ষের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এমনই ঘটনার কথা বলছিলেন নদিয়া রাজ পরিবারের প্রধান অমৃতা রায়। তিনি বলেন, “রাজবাড়ির নববর্ষের প্রধান ছিল খাওয়া দাওয়া। শাশুড়ি মা জ্যোতির্ময়ীদেবীর কাছে শুনেছি, রবীন্দ্রনাথের আসার পর থেকে নববর্ষের দিনে বাড়িতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের আসর বসাটা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়। তবে সেটা সবসময় কৃষ্ণনগরে নয়। কলকাতার নদিয়া হাউসেও বসত সে আসর। প্রসঙ্গত, এই নদিয়া হাউস এক সময় ছিল ইন্দিরাদেবী চৌধুরানীর বাড়ি। পরে তা ক্ষৌনিশচন্দ্র কেনেন।”
নববর্ষে কৃষ্ণনগর রাজপরিবারে এখনও হবেই ক্ষীরের মালপোয়া ও চিংড়ির মালাইকারি। অমৃতাদেবী বলেন, “ছানা,ক্ষীর আর সাদা ময়দা কখনও সুজি সমান পরিমানে মেশানো হত এমনভাবে যাতে কোনও দানা না থাকে। তার সঙ্গে মৌরী, গোলমরিচ মিশিয়ে গোল করে গাওয়া ঘিয়ে ভাজা হত। তারপর গাঢ় চিনির রসে ডুবিয়ে রাখা হত ঘণ্টাখানেক। পরিবেশন করার আগে উপরে কাজু, পেস্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। নববর্ষের প্রথমে এটিই প্রধান জলখাবারের পদ।”
নববর্ষের খাওয়াদাওয়া
নববর্ষে রাজবাড়িতে ক্ষীরের মালপোয়া ও চিংড়ির মালাইকারি এখনও অনিবার্য পদ।
সংক্রান্তির দিন নিরামিষ খাওয়ার পর নববর্ষের দিন কিন্তু মাছ ভাত হতেই হবে।
মোরেলগঞ্জে মেনুতে থাকত ‘ভাঙাচোরা’-র তরকারি।
নাটোরের রায়আমহাটি গ্রামের বিশেষ পদ টকের তরকারি।
মাছ ছিল রকমারি কিন্তু পেঁয়াজ ব্যবহার করা হত না মোরেলগঞ্জে।
সংক্রান্তির দিন নিরামিষ খাওয়ার পর নববর্ষের দিন মাছ ভাত বাধ্যতামূলক। মাছের পদে রাজ পরিবারে সেকাল থেকে আজ পর্যন্ত সবার আগে চিংড়ির মালাইকারি। একবিঘত লম্বা চিংড়ি মাছ সরষে তেলে হালকা ভেজে নিতে হবে। গরম মশলা ফোড়ন দেওয়া হবে। পেঁয়াজ, আদা, রসুন এবং কাঁচা লঙ্কা ধনে বেটে ভালও করে কষতে হবে। তৈরি হয়ে গেলে তাতে নামানোর আগে দেওয়া হবে নারকেলের গুঁড়ো আর নারকেল দুধ। নববর্ষে মধ্যাহ্নে নদিয়া রাজবাড়িতে এই মালাইকারি থাকবেই।
চৈত্র মাসের শেষ কটা দিন বাংলাদেশের বহু বাড়িতেই নিরামিষ খাওয়া হয়। অনেক বাড়িতে পুরুষেরা শিবের সন্ন্যাসী হন। আমিষ খাওয়া নিষিদ্ধ। আর সংক্রান্তির দিন অধিকাংশ বাড়িতে চলে ব্রতোপবাস। এই সব নিয়মভঙ্গের দিন পয়লা বৈশাখ। আমিষ সে দিন খেতেই হবে। ওপার বাংলায় নববর্ষে নিয়মটা এক হলেও আমিষ হিসেবে নববর্ষের দিন মাংস সেখানে ব্রাত্য। ব্রিটিশ শাসক মোরেল সাহেব খুলনা জেলায় গড়ে তুলেছিলেন এক জনপদ। তাঁর নাম অনুসারেই নাম মোরেলগঞ্জ। লোকমুখে মোড়লগঞ্জ। বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়ী, জোতদার, বড় চাষিদের গ্রাম ছিল সেটি। প্রচুর জমির মালিক বিশ্বেশ্বর সাহার একান্নবর্তী সংসারে নববর্ষের দিন মাছের পদ গুনে শেষ করা যেত না। বিশ্বেশ্বরবাবুর মেয়ে ৮৬ বছরের অনুপমা পোদ্দার বলেন, “নববর্ষ বা পৌষপার্বন, বিজয়ার মত বিশেষ দিনে আমার চোখের সামনে ভাসে বাড়ির রান্না ঘরের ছবি। বাবারা তিন ভাই। যৌথ পরিবার। এক এক বেলায় চল্লিশটা করে পাত পড়ত। মা-কাকিমারা শুরু করতেন পরিবেশন। এক একজনের এক একটা ‘স্পেশাল ডিস’। ২৫ বছর বয়সে সে বাড়ি ছেড়ে নবদ্বীপে এসেছেন অনুপমাদেবী। তিনি বলেন, “আমাদের গ্রামে পয়লা বৈশাখে মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। মাছের হাজারো পদ। ভেটকি, পারশে, ভুরাল, ইলিশ, চিংড়ির সঙ্গে রুই-কাতলা তো ছিলই। তবে আমরা মাছে পেঁয়াজ ব্যবহার করতাম না।”
পয়লা বৈশাখ দুপুরের মেনুতে এলাকা ভেদে একটা করে বিশেষ পদ থাকত। সেটা ওই অঞ্চলের নিজস্বতা। মোরেলগঞ্জের মানুষ খেতো তেতোহীন ভাঙাচোরার শুক্তো। অর্থাৎ মাছের মাথা, কাঁটা দিয়ে ঝিঙে আর বেগুন দিয়ে তৈরি হত এই শুক্তো। তেমনি নাটোরের রায় আমহাটি গ্রামের এ দিনের বিশেষ পদ ছিল টকের তরকারি। একদা এই গ্রামের বাসিন্দা নবদ্বীপের প্রবীন নির্মল দেব বলেন, “পয়লা বৈশাখের মেনুতে টকের তরকারি থাকতই। কচি আম, বেগুন, সজনে ডাঁটা, থোর, ডুমুর আর আলু। সঙ্গে আধসিদ্ধ মটরডাল। ধনে, শুকনো লঙ্কা, আদা জিরে বাটা। সরষে তেলে তেজপাতা, মেথি প্রভৃতি ফোড়ন দিয়ে সবজিগুলো ভালো করে ভেজে নিতে হবে। তারপর বাটা মশলা দিয়ে কষে পরিমান মতো নুন-হলুদ-চিনি দিয়ে তাঁকে হালকা আঁচে রান্না করতে হবে। নামানোর আগে ছড়িয়ে দিতে হবে আধসিদ্ধ মটরডাল। আজ এতদিন পরেও সেই সব তরকারির স্বাদ জিভে লেগে আছে।”
বছরের প্রথম দিন সুখাদ্য খেলে সারা বছর ভালোমন্দ জুটবে-এই ভরসায় বাঙালি তাঁর নববর্ষকে সাজিয়েছে সুখাদ্যে। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সময় থেকে আজ অবধি তাতে কোনও পরিবর্তন হয়নি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.