|
|
|
|
ইংরেজি বার্ডোয়ান ফিরুক বর্ধমানেই, দাবি নববর্ষের |
রানা সেনগুপ্ত • বর্ধমান |
‘বার্ডোয়ান’ নয়, বর্ধমান।
ব্রিটিশের মুখে বদলে যাওয়া উচ্চারণ আর বানানের ভূত ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে নিজের চেহারায় ফেরার দাবি অনেক দিন ধরেই উঠছে। বাংলা নববর্ষ সেই চাওয়াটাকেই ফের উস্কে দিল অনেকের মনে।
ইতিহাস বলছে, বর্ধমানের নাম ইংরেজিতে ‘বার্ডোয়ান’ হয়ে গিয়েছিল সম্ভবত সিপাহী বিদ্রোহের পরে। সেই থেকে প্রাচীন এই জনপদ ওই নামেই থেকে গিয়েছে সরকারি নথিপত্রে। তা পাল্টাতে চাইছেন শহরের বেশ কিছু মানুষ।
যুক্তিটা খুব সহজ: ‘ক্যালকাটা’ যদি ফের কলকাতা হতে পারে, ‘বোম্বে’ গিয়ে ফিরতে পারে মুম্বই, বর্ধমানই বা ইংরেজি হরফে আসল নাম লিখতে পারবে না কেন? ‘বি ইউ আর ডি ডবলিউ এ এন’ বার্ডোয়ান আর নয়, বরং ইংরেজিতেও লেখা হোক ‘বি এ আর ডি এইচ এ এম এ এন’ বর্ধমান।
কিন্তু কোনও জনপদের নাম বদল সহজ কথা নয়। নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বহু ইতিহাস, ঐতিহ্য, কাহিনি। ‘ক্যালকাটা’ নাম বদলে কলকাতা লেখা নিয়ে তো হাইকোর্টে মামলা পর্যন্ত হয়েছিল। যে কোনও শহর, রাস্তা, পার্ক, ভবন, মঞ্জিল, স্মারকের নাম পাল্টানোর কথা উঠলে অনিবার্য ভাবেই পাল্টা প্রশ্নও উঠতে থাকে। যার পিছনে মূল দাবি থাকে ইতিহাসের। |
|
|
কোথাও ‘বার্ডোয়ান’, তো কোথাও ‘বর্দ্ধমান’। হাজির অতি চেনা ‘বর্ধমান’ বানানও। (বাঁ দিক থেকে) জেলাশাসকের অফিস, রেলের ডাকঘর, |
|
বর্ধমানের নামের উৎস কোথায়, তা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। কেউ মনে করেন, জনপদ ক্রমবর্ধমান ছিল বলে তার নাম হয় বর্ধমান। কেউ বা বলেন, জৈন ধর্মগুরু মহাবীর বর্ধমান এই রাঢ়দেশে পরিভ্রমণে আসায় তাঁর নামেই এই জনপদের নামকরণ। তবে ‘বর্ধমানভুক্তি’ নামে জনপদের উল্লেখ প্রথম মেলে গলসির মল্লসারুলে প্রাপ্ত তৃতীয় গোপচন্দ্রের সামন্তরাজ বিজয় সেনের প্রচারিত খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের তাম্রফলকে। নয় পালের ইর্দা তাম্রফলক, বল্লাল সেনের উদ্ধারণপুর নৈহাটির তাম্রফলক, লক্ষ্মণ সেনের গোবিন্দপুরের তাম্রফলক ইত্যাদিতেও এমন আরও নানা উল্লেখ মিলেছে।
কিন্তু ইংরেজিতে ‘বর্ধমান’ লেখার পক্ষে যাঁরা সওয়াল করছেন, তাঁদের যথেষ্ট যুক্তি আছে।
বর্ধমান জেলা জজ কোর্টের আইনজীবী পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “বার্ডোয়ান নিয়ে বিস্তর সমস্যা হয়। অনেকে এমন টেনে ‘বার্ডোয়ান’ লেখেন যে লোকে ‘বান্দোয়ান’ পড়ে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের বহু সরকারি মামলার নথি পুরুলিয়ার বান্দোয়ানে চলে যাচ্ছে। বন্দোয়ানেরটা চলে আসছে আমাদের কাছে।” বর্ধমানের পুরপ্রধান আইনূল হক বলেন, “ইংরেজদের তৈরি ওই বানান বদলে আমাদের উচিত ইংরেজিতে বি এ আর ডি এইচ এম এ এন লেখা। সরকারেরও এই ব্যাপারে নির্দেশিকা জারি করা।”
কিন্তু এ রকম কোনও পরিবর্তন মানেই ঐতিহ্যের সঙ্গে সংঘাত প্রায় অনিবার্য। যেমন ‘ক্যালকাটা’ কলকাতা হওয়ার পরেও ‘ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি’ তার নাম পাল্টায়নি। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ডে যে ‘বার্ডোয়ান’ নাম জ্বলজ্বল করছে, তার কী হবে? উপাচার্য স্মৃতিকুমার সরকার বলেন, “এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জাতীয় পর্যায়ে বার্ডোয়ান বলেই উল্লিখিত। পাল্টাতে গেলে মন্ত্রিসভার বৈঠক করতে হবে। নিতে হবে আচার্য রাজ্যপালের সম্মতি। |
|
|
রেলস্টেশন ও পুরসভার বোর্ড দেখলেই পরিষ্কার, এক-এক জায়গায় এক-এক
রকম বানান। ইংরেজিতে তো বটেই, বাংলাতেও। কোনটা তবে ঠিক? |
|
আমি ব্যক্তিগত ভাবে ইংরেজিতে বর্ধমান লেখা পছন্দ করলেও বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভবত থাকবে বার্ডোয়ান হয়েই।”
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিয়ামের কিউরেটর রঙ্গনকান্তি জানার মতে আবার, “ইংরেজ আমলের বার্ডোয়ান বদলে ইংরেজিতে ‘বর্দ্ধমান’ লেখা উচিত। একটা বাড়তি ‘ডি’ দিয়ে।” তাঁর ব্যাখ্যা, জনপদটি ক্রমবর্ধমান ছিল অর্থাৎ ক্রমশ বাড়ছিল বলেই এক সময়ে ওই নাম হয়েছিল। ১৯৬০ সালের শেষ দিকে যে জেলা গেজেটিয়ার প্রকাশিত হয়, তাতে ঐতিহাসিক শশীভূষণ চৌধুরী, বরুণ দে-সহ বিশিষ্টদের উদ্যোগে জেলার নামের ইংরেজি বানান লেখা হয়েছে ‘বি এ আর ডি ডি এইচ এ এম এ এন’। সেই বানানটিই রাখা উচিত বলে মনে করছেন রঙ্গনবাবু।
বর্ধমান রেলস্টেশনের বোর্ডে ওই বানানটিই রয়েছে। অর্থাৎ, বাংলা বানানে ‘র্দ্ধ’, ইংরেজিতে সেই জায়গায় একটি অতিরিক্ত ‘ডি’। শহরের নাট্যব্যক্তিত্ব দেবেশ ঠাকুর, বা তাঁর মতো অনেকেই কিন্তু ‘বার্ডোয়ান’ নাম ঝেড়ে ফেলতে চাইলেও ওই বানান ব্যবহারের আদৌ পক্ষপাতী নন। দেবেশবাবুর যুক্তি, “বাংলায় যুক্তাক্ষর ক্রমেই কমে আসছে। তাই ‘বর্দ্ধমান’ নয়, লেখা হোক স্রেফ বর্ধমান। তা সকলের পক্ষেই ব্যবহার করা সহজতর হবে।”
বর্ধমান ও শান্তিনিকেতন থেকে একযোগে প্রকাশিত একটি সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক স্বপ্নকমল সরকারও ওই ‘র্দ্ধ’ বা অতিরিক্ত ‘ডি’ চাইছেন না। লেখক রূপক মিত্রের দাবি, “বেশ কয়েকটি সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেই বর্ধমানের বানান ‘বি এ আর ডি এইচ এ এম এ এন’ লেখা হয়েছে। আমাদেরও সকলের একযোগে ওই বানান লেখা উচিত।” জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনার বক্তব্য, “ইংরেজিতে বর্ধমান বা বার্ডোয়ান, দু’টি বানানই লেখা যেতে পারে। দু’টিই শুদ্ধ। বর্ধমান শহরের বা জেলার বাসিন্দারা সকলেই কাল থেকে ইংরেজিতে ‘বি এ আর ডি এইচ এ এম এ এন’ লিখলেও কোনও সমস্যা নেই। তবে সরকারি ভাবে জনপদের নামের বানান পাল্টাতে হলে রাজ্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দিতে হবে।” তবে জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে যে অনেক আগেই থেকে বার্ডোয়ানের বদলে তাঁরা বর্ধমান লিখছেন, তা-ও তিনি জানাতে ভোলেননি। |
ছবিগুলি তুলেছেন উদিত সিংহ। |
|
|
|
|
|