সিপিএম-তৃণমূলের মিছিলকে ঘিরে গণ্ডগোলের জেরে এ বার উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব, বিধায়ক রুদ্রনাথ ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করল পুলিশ। এর মধ্যেই ধৃত এক ডিওয়াইএফ কর্মীর মায়ের মৃত্যুতে পরিস্থিতি কিছুটা জটিল হয়ে পড়েছে।
সিপিএমের দুই কর্মীর আলাদা ভাবে করা অভিযোগের ভিত্তিতে দু’টি মামলা পুলিশ দায়ের করেছে। সিপিএম কর্মী মনামি মিত্র সান্যাল অভিযোগ করেছেন, গত বুধবার হিলকার্ট রোডে তাঁদের অফিসে হামলার সময়ে উস্কানি দিয়েছেন গৌতমবাবু এবং রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য। এ ছাড়া, সিপিএম কর্মী মহম্মদ দত্তকি প্রায় একই ধরনের অভিযোগে গৌতমবাবু এবং রুদ্রনাথবাবুর নাম উল্লেখ করেছেন। দু’টি অভিযোগের ভিত্তিতে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী ও শিলিগুড়ির বিধায়ক-সহ কয়েক জনের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক উদ্দেশে সিপিএম অফিসে অনধিকার প্রবেশের চেষ্টা, বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা এবং অন্যের জীবন বিপন্ন করার চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে। যদিও সব ক’টি মামলাই জামিনযোগ্য ধারায় রুজু হয়েছে এবং ওই দু’জনকে এখনই গ্রেফতারের কোনও ব্যাপার নেই বলে পুলিশ সূত্রের খবর।
শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার আনন্দ কুমার, শিলিগুড়ির অতিরিক্ত ডেপুটি পুলিশ কমিশনার আভারু রবীন্দ্রনাথ ‘বিষয়টি জানা নেই’ বলে এড়িয়ে গিয়েছেন। তবে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী বলেছেন, “সিপিএমের একটি অভিযোগে যে দিনক্ষণ দেওয়া হয়েছে, সে সময়ে আমি শিলিগুড়িতে ছিলাম না। অন্য অভিযোগে যে সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তখনও আমি সেখানে ছিলাম না। তবুও মামলা হয়েছে বলে শুনেছি। আইন আইনের পথে চলুক।” মন্ত্রীর অভিযোগ, বাম আমলেও তাঁকে একাধিকবার পুলিশ দিয়ে নানা ভাবে হেনস্থা করার চেষ্টা হয়েছে। মারধরও করা হয়েছে। গৌতমবাবু বলেন, “সিপিএম নেতাদের দিক থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় ওঁরা শিলিগুড়িকে কী ভাবে অশান্ত করতে চাইছেন তা সকলেই দেখছেন।”
এই ঘটনায় পুলিশের একাংশের বিরুদ্ধে পক্ষপাত করার অভিযোগ তুলেছে সিপিএম। প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের অভিযোগ, “তৃণমূলের অভিযোগের ভিত্তিতে আমাদের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার মামলা রুজু হল। ৫১ জনকে ধরা হল। পার্টি অফিসে ঢুকে পুলিশ আমাদেরও ধরল। অথচ, আমাদের অভিযোগের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। পুলিশের একাংশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।” পুলিশ উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রীর চাপেই এমন ভূমিকা নিতে বাধ্য হচ্ছে বলে অশোকবাবুর অভিযোগ। অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন মন্ত্রী।
তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও অশোকবাবুরা শান্তি রক্ষার জন্য প্রশাসনের কাছে সর্বদল বৈঠকের দাবি জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে এখনই তাঁরা প্রকাশ্যে আর কোনও মিটিং-মিছিল করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। আগামী ১৯ এপ্রিল শিলিগুড়ি আসার কথা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রর। তিনি শিলিগুড়িতে হলঘরে বৈঠক করবেন বলে জানান অশোকবাবু। দলের যে সমস্ত নেতা-কর্মীরা জামিন না পেয়ে জেলে রয়েছেন, তাঁদের পরিবারের সঙ্গে সূর্যকান্তবাবুর
দেখা করার কথাও রয়েছে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রীর মন্তব্য, “সিপিএম
শহরকে অশান্ত করতে চাইছে। আবার সর্বদল বৈঠকের দাবি জানাচ্ছে। যারা অশান্তি চায়, তাদের সঙ্গে সর্বদল বৈঠক হয় না।”
এরই মধ্যে শিলিগুড়ি পুরসভার মেয়র তথা কংগ্রেস নেত্রী গঙ্গোত্রী দত্ত শিলিগুড়ি জেলে গিয়ে বন্দি সিপিএম নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দেখা করেছেন। তা নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের দার্জিলিং জেলার মহাসচিব কৃষ্ণ পালের মন্তব্য, “আমরা পুরসভায় সমর্থন প্রত্যাহারের পরে কংগ্রেসের বোর্ড সংখ্যালঘু। বামেরা অনাস্থা আনছে না। সে জন্যই কৃতজ্ঞতা জানাতে মেয়র জেলে গিয়েছিলেন বলে মনে হচ্ছে।” যদিও মেয়র জানান, তিনি অন্য কাজে জেলে গিয়েছিলেন। তাঁর দাবি, সৌজন্যের খাতিরে বন্দি সিপিএম নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দেখা করেছেন।
বুধবার শিলিগুড়িতে সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেফতার এক ডিওয়াইএফ সদস্য অমিত দে-র মার মৃত্যু হওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। মৃত মহিলার নাম বাণী দে (৫৫)। শিলিগুড়ির দেশবন্ধুপাড়ার শাখা সম্পাদক অমিত। তিনি জামিন না পাওয়ায় মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন বাণীদেবী। শনিবার অমিতের বাড়ির লোকেরা জানিয়েছেন, তাঁরা ভেবেছিলেন শুক্রবারই জামিন পেয়ে যাবেন অমিত। কিন্তু সে দিন শুনানি না হওয়ায় অমিত জামিন পাননি। শনিবার সকালে বাণীদেবীর সঙ্গে দেখা করেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য। তিনি বাণীদেবীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, “আমরা অমিতের পাশে রয়েছি। চিন্তা করবেন না।” দুপুর নাগাদ বাণীদেবী হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাড়িতেই তাঁর চিকিৎসা চলে। অবস্থার অবনতি হলে রাত দশটা নাগাদ তাঁকে শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিছু ক্ষণ পরে বাণীদেবী মারা যান। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই হাসপাতালে ভিড় জমান সিপিএমের নেতা-কর্মীরা।
হাসপাতালে দাঁড়িয়ে অশোকবাবু বলেন, “আমি তো সকালে গিয়েও তাঁকে বুঝিয়েছিলাম। বলেছিলাম চিন্তা করবেন না। দলের কর্মীদের মারফত অমিতও জেল থেকে চিঠি
পাঠিয়ে মাকে চিন্তা করতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু একমাত্র সন্তান জেলে থাকায় বাণীদেবী অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন বলে মনে হয়। যাঁদের দোষে আজকের এই ঘটনা, তাঁদের শাস্তি চেয়ে আগামী দিনে নেতা-কর্মীদের মায়েরা শিলিগুড়ির রাস্তায় নামবেন।” |