রাজ্যে ডাক্তার বাড়ন্ত। তাই সরকারি ডাক্তারদের স্বেচ্ছাবসর নেওয়া বন্ধ করছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
এত দিন ২০ বছর চাকরি অথবা ৫০ বছর বয়স হয়ে গেলে কোনও সরকারি ডাক্তার স্বেচ্ছাবসর নিতে পারতেন। বহু কালের এই সরকারি নিয়ম এখন স্বাস্থ্য দফতর ভাঙতে চায়। কিন্তু কেন? স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, “সরকারি ডাক্তাররা সারা জীবন ভাল মাইনে পাবেন, পদোন্নতি হবে, নিজের আখেরটা গুছিয়ে নেবেন, তার পরে যখন দফতরের তাঁকে প্রয়োজন হবে, তখন স্বেচ্ছাবসর নিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে চলে যাবেন, এটা বরদাস্ত করা হবে না।” তাঁর সাফ কথা, “ইচ্ছা হলেই এখন আর ডাক্তারেরা চাকরি ছাড়তে পারবেন না। চাকরির পুরো মেয়াদটাই থাকতে হবে। এটা পছন্দ না হলে তিনি আদালতেও যেতে পারেন।” সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ‘জুলুমবাজি’ বলে বর্ণনা করছেন স্বেচ্ছাবসরের আবেদনকারী ডাক্তারদের একাংশ।
সরকারের এই নয়া ফরমান আনুষ্ঠানিক ভাবেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে স্বেচ্ছাবসরে আগ্রহী চিকিৎসকদের। স্বাস্থ্য দফতরের খবর, রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পরে গত দু’বছরে প্রায় ৬০ জন সরকারি চিকিৎসক স্বেচ্ছাবসরের আবেদন জানিয়েছেন। এত দিন তাঁদের আবেদনের উত্তর দেওয়া হয়নি। কিন্তু মাসখানেক আগে প্রত্যেককে চিঠি দিয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বলা হয়েছে, ‘আপনার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হল। আপাতত কোনও ডাক্তারকে স্বেচ্ছাবসর দেওয়া হবে না’।
কিন্তু এ ভাবে কি ফতোয়া জারি করা যায়? স্বাস্থ্যশিক্ষা-অধিকর্তার দাবি, “আলবাত যায়। আমাদের এখন ডাক্তারের প্রয়োজন। এত মেডিক্যাল কলেজ হবে, সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল হবে। ডাক্তার কোথায় পাব। ডাক্তার এখন ছাড়া যাবে না।”
এখানেই শেষ নয়। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য দফতরকে আগাম না জানিয়ে যে সব সরকারি চিকিৎসক কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দফতরের উপদেষ্টা বা অন্য কোনও পদে যোগ দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছেন, তাঁদেরও ছাড়া হবে না। কারণ, তাঁরা রাজ্যের কর্মী। তাঁদের রাজ্যের প্রয়োজনটাই অগ্রাধিকার দিতে হবে।
স্বাস্থ্য দফতরের খবর, স্বেচ্ছাবসরের আবেদনে অসম্মতি জানানোর পাশাপাশি ডাক্তারদের চাকরির বয়স ৬০ থেকে বাড়িয়ে ৬২ করার সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করাটা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। এই ভাবেই ডাক্তারের অভাব মেটানোর আপ্রাণ চেষ্টা চলছে।
সরকারের এই নতুন ঘোষণায় আপাতত মিশ্র প্রতিক্রিয়া চিকিৎসক মহলে। তবে বেশির ভাগ ডাক্তারই মনে করেন, চিকিৎসার মতো একটি বিশেষ পেশার ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্ত না নেওয়ায়ই বাঞ্ছনীয়। কারণ, চাপ সৃষ্টি করে ভাল চিকিৎসা আদায় করা যায় না। অবসরের আবেদনকারী বর্ধমানের এক চিকিৎসকের কথায়, “হাসপাতালে রোগীর চাপ মারাত্মক ভাবে বাড়ছে। অথচ সরকার পরিষেবা দিচ্ছে না। কিছু সমস্যা হলেই রোগীর বাড়ির পুরো রাগ, ক্ষোভ এসে পড়ছে আমাদের উপর। শাস্তির খাঁড়া নামছে আমাদের উপর। এত বয়সে এই সব ভাল লাগছে না। এর থেকে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে টাকাও বেশি, কাজও অনেক ঝঞ্ঝাটহীন।” মুর্শিদাবাদের এক প্রবীণ চিকিৎসকের আবার ক্ষোভ, “আউটডোরে কখন যাচ্ছি সেটা আবার এসএমএস করতে হচ্ছে! সময় ধরে না-পৌঁছলে শো-কজ। কর্মী নেই, পরিকাঠামো নেই, অথচ রোগীর ক্ষতি হলে আমাদের জরিমানা হচ্ছে। এ ভাবে কাজ করা যায় না বলে চাকরি ছাড়তে চেয়েছি। এ বার মনে হচ্ছে আদালতেই যেতে হবে।”
আবেদনকারী কয়েক জন ডাক্তারের অভিযোগ, শাসকদলের কয়েক জন ডাক্তার নেতা যে ভাবে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন তাতে কাজ করাটাই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপমানিত হতে হচ্ছে। এক জন বললেন, “শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীর পাঠানো রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির জন্য চাপ আসছে। সেটা সম্ভব না হলে তাঁদের রোষে পড়তে হচ্ছে। তাই অবসর চেয়েছিলাম। এখন সেটাও দেবে না বলছে।” |