দেশে দেশে নতুন বছর
কটা মাথা, দেহ অবিচ্ছিন্ন। কিন্তু মুখ দুটো। ‘সূত্রপাত-এর দেবতা’ জানুস-এর (ল্যাটিনে ‘লানুস’) আদল ছিল এ রকমই। প্রবেশপথ বা তোরণের দেব হিসাবেও আরাধ্য ছিলেন। একটা মুখ সামনের দিকে, একটা পিছনে। প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের নববর্ষে উত্‌সব হত এই ‘জানুস’-কে ঘিরে। এখনও জানুসের মূর্তি দেখা যায় ভ্যাটিকান জাদুঘরে। ‘টেম্পল অব জানুস’-এর ছবি খোদাই করে মুদ্রা বার করেন সম্রাট নিরো। ইতালির ছোট্ট শহর ভেলাব্রো-র সেন্ট জর্জের গির্জায় রয়েছে ‘আর্চ অব জানুস’। আর তাঁর নাম থেকে নেওয়া নববর্ষের শুরুর মাস জানুয়ারি স্থায়ী ভাবে রয়ে গিয়েছে আমাদের জীবনে। যুগান্তরের সঙ্গে সঙ্গে বদলিয়েছে নববর্ষের সময়, উদ্‌যাপনের ঘরানা।
প্রাচীন মিশরে প্রচলিত ছিল ‘কোপটিক’ বা আলেকজান্দ্রীয় বর্ষপঞ্জি। এতে ৩০ দিনের ১২ মাস, সঙ্গে পাঁচ দিনের ছোট্ট এক মাস। তৃতীয় টলেমির সময় (খ্রিষ্টপূর্ব ২৩৮) সেটির সংস্কার হয়। নববর্ষের দিন মিশরীয়রা পালন করতেন ‘Ni Yarouou’ (নদীর উত্‌সব)। এটা থেকেই এসেছে ইরানের নববর্ষের ‘নওরুজ’।
রোমের প্রাচীন বর্ষপঞ্জির অল্প পরিমার্জন করে জুলিয়াস সিজার একটি সৌরপঞ্জিকা তৈরি করান। খ্রিষ্টজন্মের ৪৬ বছর আগের কথা। খ্রিষ্টপূর্ব ৪২ সালে রোমান সেনেট ১২ মাসের এই পঞ্জিকার (জুলিয়ন ক্যালেন্ডার) সরকারি স্বীকৃতি দেয়। তাতে ছিল ৩৬৫ দিন। ‘লিপ ইয়ার’ হিসাবে ৪ বছর অন্তর এক দিন বাড়তি। ‘ভার্নাল ইকুইনক্স’ ছিল ২৫ মার্চ। এক বছরের চেয়েও বেশি ছিল ‘জুলিয়ান’ বছর। তখন সেটাই ছিল মূল নববর্ষ।
১৫৮২ সালে ত্রয়োদশ পোপ গ্রেগরি নতুন ক্যালেন্ডার চালু করেন। এতে বছরের প্রথম দিন ধার্য হয় ১ জানুয়ারি। গ্রেগরি (‘লিটার্জিক্যাল’) ক্যালেন্ডার অচিরেই সারা পৃথিবীতে গৃহীত হল। এতে উল্লেখিত বছরের প্রথম দিন হয়ে উঠল পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে মূল নববর্ষ। খোদ ব্রিটেনে আগে নববর্ষ উদ্‌যাপন হত ২৫ মার্চ। দিনটিকে বলা হত ‘ফিস্ট অব দি অ্যানানসিয়েশন’। ১৭৫২ সালে সে দেশে চালু হয় গ্রেগরি ক্যালেন্ডার।
৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাই পয়গম্বর হজরত মহম্মদ মক্কা থেকে মদিনা চলে যান। আরবি ‘হিজরা’ শব্দটির অর্থ ‘গৃহ ও বন্ধুদের ছেড়ে চলে যাওয়া’। ইসলামি বর্ষপঞ্জিকে বলা হয় ‘হিজিরা’। ইসলামি বর্ষপঞ্জির দিনসংখ্যা গ্রেগরি বর্ষপঞ্জির দিনের সংখ্যার চেয়ে চেয়ে ১১-১২ দিন কম। এই দুই নববর্ষের ব্যবধান তাই প্রতি বছর বদলায়। এ বছর ইসলামি নববর্ষ (১৪৩৫ হিজিরা) শুরু হবে ৪/৫ নভেম্বর। আগামী বছরের (১৪৩৬ হিজিরা) নববর্ষ পড়বে ২০১৪-র ২৪/২৫ অক্টোবর। সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে ১৭ এপ্রিলের সঙ্গে ১ জানুয়ারিতেও মহা উল্লাসে পালিত হয় নববর্ষ। যেমন, আমাদের দেশেও ঔপনিবেশিক প্রভাবে ১ জানুয়ারি একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন হয়ে উঠেছে।
১৯৫৭ সালে ভারত সরকার বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিটি তৈরি করে। সেই কমিটির সুপারিশে চালু হয় ‘শকাব্দ’। কিন্তু আমাদের চোখে নববর্ষ বলতে ভেসে ওঠে ১ বৈশাখের ছবি। দুই বাঙলাতেই।
দুই বাংলায় নববর্ষ একই দিনে হলেও বাংলা ক্যালেন্ডারের দিনক্ষণে রয়েছে পার্থক্য। লিপ ইয়ারের বিষয়টিকে বাংলা ক্যালেন্ডারে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে স্থান দিতে পূর্ব পাকিস্তান প্রশাসন বাংলা অকাদেমিকে দায়িত্ব দেয়। ১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মহম্মদ শহিদুল্লার নেতৃত্বে তৈরি হয় কমিটি। তাদের সুপারিশ সরকারি ভাবে গৃহীত হয় ১৯৮৭-তে। এতে বছরের প্রথম ৫ মাস ৩১ দিনে, পরের ৭ মাস ৩০ দিনে। যে বছর লিপ ইয়ার, সে বছর ফাল্গুন মাস ১ দিন বেশি অর্থাত্‌ ৩১ দিনে।
ইয়েমেনের নববর্ষ ৬ এপ্রিল। নেপালের ১৪ এপ্রিল। মায়ানমারেও এপ্রিল মাসে। মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও চিনে নববর্ষ ফেব্রুয়ারিতে। তিব্বতিদের নববর্ষ ‘লোসার’-ও উদ্‌যাপিত হয় ১৮ জানুয়ারি। পড়শি দেশ পাকিস্তান আর ভারত মহাসাগরের মলদ্বীপের নববর্ষ ১৭ এপ্রিল। কুয়েত-সহ মুসলমানপ্রধান কিছু দেশে নববর্ষ গ্রেগরিয়ান কালেন্ডার মেনেই উদ্‌যাপিত হয় ১ জানুয়ারি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো ছাড়াও প্যারাগুয়ে, পানামা, পেরু, তাইল্যান্ড, সিয়েরা লিওন, কিরঘিজস্তানের মতো দেশগুলোতেও তাই।
কলকাতায় একাধিক জায়গায় সাংস্কৃতিক নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পালিত হয় নববর্ষ। ঢাকার উত্‌সবের ব্যপ্তি আরও বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা ময়দান এ সব অঞ্চলে সমবেত আবালবৃদ্ধবণিতা ওই দিন সকাল থেকে মেতে ওঠেন নাচ-গান, কবিতা, নাটক নিয়ে। অসম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, বিহারের বাঙালি-পরিবারগুলোও ওই দিন নেচে ওঠে শিকড়ের সন্ধানে। মায়ানমারে নববর্ষ উদ্‌যাপনের সঙ্গে চলে ‘মহাথিঙ্গন’ উত্‌সব আর জলক্রীড়া। শ্রীলঙ্কায় নববর্ষ (‘আলুথ আবুরুদ্দ’) পালিত হয় এপ্রিল মাসের ১৩-১৪ তারিখে, চাষের মরশুম শেষ হিসাবে। শ্রীলঙ্কার মতো ভারতের তামিলরাও ওই দিন পালন করেন নববর্ষ (‘পাথান্ডু’)। ওই দিনে মন্দিরে মন্দিরে চলে পঞ্জিকা (‘পঞ্চঙ্গম’) পাঠ।
ফেব্রুয়ারিতে চিনের চান্দ্র-নববর্ষ। একে বলে ‘চুন জি’, ইংরেজিতে ‘স্প্রিং ফেস্ট’। বেজিংয়ের হোউহাই হ্রদে, মন্দিরের মেলায় ভিড় জমান উত্‌সাহীরা। চিনের প্রাচীরের একটি বিশেষ অংশে ওই দিন বসে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। পর্যটকদের জন্য থাকে বিশেষ প্যাকেজ। প্রতি বছর চিনের নববর্ষে থাকে বিশেষ থিম। গত বছর ছিল ড্রাগন। এ বার সাপ। লাল পোশাক, লাল সাজবাতিতে সেজে ওঠে চিনের জনজীবন। আগে চিন ও জাপানের নববর্ষ হত একই দিনে। এখন জাপানে হয় গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী।
নববর্ষের সন্ধ্যা স্পেনে পরিচিত ‘vispera de Ario Nuevo’ হিসাবে। ১ জানুয়ারি কোরিয়াতে ‘সিওনাল’, ১১/১২ সেপ্টেম্বর ইথিওপিয়ায় ‘এঙ্কুটাটাশ’-এর মতোই হল্যান্ডে ‘Nieuvwjaar sdag’, বেলজিয়ামে ‘Sint Sylvester vooravond’ (সন্ত সিলভেস্টারের সন্ধ্যা), ফ্রান্সে ‘la Saint-Sylvestre’, ইতালিতে ‘vigilia di capodanno’ অথবা ‘Notte disan Silvestro’ পালিত হয় ঘটা করে। ওয়াশিংটন থেকে প্যারিস, মাদ্রিদ থেকে নিউ ইয়র্ক-পশ্চিমি প্রধান শহরগুলো গোটা রাত জেগে থাকে ওই দিন। গানে বাজনায় ভরপুর থাকে রেস্তোরাঁগুলো।
পশ্চিমি দেশগুলোয় গির্জা ও জাহাজের ঘণ্টাধ্বনি আহ্বান জানায় নববর্ষকে। গির্জায় গির্জায় তৈরি হয় ঝুলনের মতো প্রভু যিশুর জন্মবৃত্তান্ত। চলে পারস্পরিক শুভেচ্ছাজ্ঞাপনের পর্ব। আবালবৃদ্ধবণিতার একটা বড় অংশ মেতে ওঠেন আতসবাজি নিয়ে। জার্মানির নববর্ষের প্রধান উত্‌সবটি হয় বার্লিন প্রাচীরের মূল ফটক ব্রান্ডেনবুর্গ গেটের সামনে। লন্ডনে বিগ বেন এবং ওয়েস্টমিনিস্টার প্রাসাদের ঘড়িঘরকে ঘিরে। সেই উত্‌সব গোটা ব্রিটেনে বিবিসি সরাসরি সম্প্রচার করে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.