মাছে-ভাতে বাঙালি। কিন্তু পাতের মাছ গেল কোথায়?
উত্তর শহরতলির বেলঘরিয়ার নন্দননগর বাজারে কাটাপোনা কিনতে কিনতে এক প্রৌঢ়ের হতাশা, “শেষ কবে ভাল সাইজের পাবদা পেয়েছি, ভুলতে বসেছি। আর কাজরি? সে তো যেন উবেই গিয়েছে!” পমফ্রেট, ভেটকি, ট্যাংরা, পার্শে, পাবদা, কাজরি, জ্যান্ত কালো কুচকুচে তেলাপিয়া, মৃগেল মাছের এখন দেখা মেলা ভার। সরপুঁটি, মৌরলা, কই মাছই বা কোথায়? চালানি রুই-কাতলার দামও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। নববর্ষের মুখে মাছের দাম আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা ক্রেতাদের। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও দিন কয়েক আগে মহাকরণে বাজারদর নিয়ে গঠিত টাস্কফোর্সের বৈঠকে মাছের দাম বাড়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
প্রশাসন সূত্রের খবর, সমস্যা চাহিদা-জোগানের। দৈনিক এ রাজ্যে মাছের চাহিদা প্রায় ৫০০ টন। সেখানে মাছের জোগান এখন ২০০-২৫০ টন। পরিস্থিতি সামলাতে মুখ্যমন্ত্রীর সাধের ‘জল ধরো, জল ভরো’ কর্মসূচির সঙ্গে মাছচাষে উৎসাহ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। |
কেন এই দশা? গড়িয়াহাট বা পাতিপুকুর বাজারের মাছ বিক্রেতাদের মতে, গরমের এই সময়ে ট্যাংরা-পার্শের মতো মাছের জোগান কমই থাকে। কিন্তু, এ বার যেন পরিস্থিতি আরও খারাপ। তার কারণ, কলকাতা সংলগ্ন ভেড়ির জল কমে গিয়েছে, বলছেন ব্যবসায়ীরা। মানিকতলা ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক প্রভাত দাস বলেন, “এ বার মাঘ-ফাল্গুনে একফোঁটা বৃষ্টি হয়নি। চৈত্রেও বৃষ্টি নেই। সেই সঙ্গে নদীর জল ভেড়ি পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না।” প্রভাতবাবুর মতে, সংস্কারের অভাবেও অনেক ভেড়ির জল শুকিয়ে যাচ্ছে।
কমছে ছোট মাছের চাষও। মৎস্য ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, গত কয়েক বছর ধরে ভেড়িগুলোতে পার্শে, ট্যাংরা, বা ভেটকি চাষের থেকে মৎস্যচাষিরা বেশি উৎসাহিত হচ্ছেন বাগদা চিংড়ি চাষে। কারণ, বাগদা চিংড়ির বিদেশে প্রচুর রফতানি হয়। বাগদা চিংড়ি চাষের খরচও কম।
ভিন্ রাজ্য থেকে রুই-কাতলা বা তেলাপিয়ারও আমদানি কমেছে। পাতিপুকুর বাজারের আড়তদার উত্তম হাজরা বলেন, “গত কয়েক বছরে পরিবহণ খরচ এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে অন্ধ্র থেকে মাছের গাড়িই ঢুকছে খুব কম।” তিনি জানালেন, অন্ধ্র থেকে এক ট্রাক মাছ আসার খরচ ২২ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। তাই আমদানিতে উৎসাহ হারাচ্ছেন অনেক ব্যবসায়ী। অন্ধ্রেও মাছ চাষ কমেছে। নানা সমস্যায় জেরবার হয়ে সে রাজ্যের বহু মাছচাষি পুরনো পেশা ছেড়েছেন।
এ সবের সঙ্গে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বাংলাদেশ থেকে এ রাজ্যে মাছ আমদানিকারীদের অন্যতম সংস্থা ‘ফিশ ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন’ সূত্রের খবর, বেহালা, শিয়ালদহ, বারাসত, পাতিপুকুর বাজারে যে-পার্শে, ভেটকি, কই বিক্রি হতে দেখা যায়, তার প্রায় সবটাই খুলনা, সাতক্ষীরা থেকে আসে। সংগঠনের সভাপতি অতুলচন্দ্র দাস বলেন, “বছরের এই সময়ে প্রাকৃতিক কারণেই পারশে, ভেটকি, গজাল প্রভৃতি মাছ বাংলাদেশ থেকে একটু কম আসে। তার উপরে সে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির জেরে মাছ আমদানির হাল আরও খারাপ হয়েছে। গত বছর মার্চ মাসে গড়ে দৈনিক যেখানে ২০ থেকে ২৫ টন মাছ আমদানি হত, এ বছর তা দাঁড়িয়েছে দৈনিক ২ থেকে ৪ টন।”
জোগান কমে যাওয়ায় পাইকারি দাম বেড়েছে। তার জেরে খোলা বাজারেও মাছের আগুন দাম। এখন ভেটকির পাইকারি মূল্যই ৩৫০-৪০০ টাকা। জোগান বেশি থাকলে যা ঘোরাফেরা করে ২৫০-৩০০ টাকার মধ্যে। পার্শের পাইকারি মূল্যও ২৫০-৩০০ টাকা।
রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ বলেন, “সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। ওঁরাও আমাদের এ ব্যাপারে চিঠি দিয়েছেন। চিঠি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। ওখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, আমাদের এখান থেকে মাছ আমদানিকারীদের এক প্রতিনিধি দল সে দেশে যাবে। মাছ আমদানি-রফতানি স্বাভাবিক করার সঙ্গে যে সব মাছ আমদানি নিয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তা নিয়েও আলোচনা হবে।”
মানিকতলা বাজারের আড়তদার বাবু মান্না অবশ্য কূটনীতির চাইতে ভরসা করছেন প্রকৃতির উপরে। বলছেন, “গরম মাছের মরসুম নয়। বর্ষা আসতে দিন।” নববর্ষে তাই বর্ষার দিকে চেয়ে দিন গুনছে বাঙালি। |