ঐতিহ্যে ভাগ বসাচ্ছে আধুনিকতা। বাঁশির সুরের জায়গা নিচ্ছে উচ্চ ক্ষমতার অ্যাম্পলিফায়ার থেকে ভেসে আসা ততোধিক উচ্চকিত, ভোজপুরি গান। ধামসা মাদলের দ্রিম দ্রিম শব্দের জায়গা নিয়েছে অত্যাধুনিক তালবাদ্যের ‘বিট’। সাদা ধুতি আর লাল পাড়ের সাদা শাড়ির জায়গা নিয়েছে স্নিকার, জিনস, সালোয়ার, স্কার্ট। কোনও মতে শুধু টিকে রয়েছে মহিলাদের একে অন্যের কোমর ধরে লোকনৃত্যের পরিচিতি দৃশ্যটি। কার্যত উধাও হয়ে যাওয়া আদিবাসী সংস্কৃতির দৃশ্যই আজ শহরের আনাচে-কানাচে ধরা পড়ল ‘সরহুল’ পরবে।
সরনা আদিবাসীদের বসন্তের উৎসব সরহুল পুজো। যা আসলে প্রকৃতি পুজো। যেখানে শালগাছকে উপাস্য দেবতা হিসেবে মানা হয়। দিনের বেলায় পুজো করার পরে সন্ধ্যার পরে আদিবাসীরা পরিচিতদের নিয়ে উৎসবে মেতে ওঠেন। সেখানে নাগারা, মাদল ও বাঁশির সঙ্গে লোকগান, আর লোকনৃত্য। সেটাই রীতি। যা এ দিন রাঁচি কিংবা জামশেদপুরের মতো শহর এলাকাগুলি থেকে অনেকটাই উধাও। |
সরহুল পরবে আদিবাসী কিশোর-কিশোরীদের উদ্দাম নাচ। জামশেদপুরে। ছবি: পার্থ চক্রবর্তী |
আজকের দিনে আদিবাসীরা নিজেদের এলাকা থেকে দল বেঁধে বেরিয়ে নির্দিষ্ট একটি জায়গায় জড়ো হয়ে পুজো দেন। রাঁচির সেরম টোলিও তেমনই একটি আরাধনা স্থল। সাদার ওপরে লাল দাগ দেওয়া পতাকা নিয়ে মিছিল করে দলে দলে আদিবাসীরা এসে জড়ো হয়ে আজ সেখানে পুজোও দিয়েছেন। প্রতিটি মিছিলেই গমগম করে চড়া সুরে বাজতে শোনা গেছে ভোজপুরি, নয়তো হিন্দি ছবির গান। আর তার সঙ্গে বলিউডি কায়দায় কোমর দোলাতে দেখা গিয়েছে ছেলেমেয়েদের।
গালুডিহির বাসিন্দা আদিবাসী পাহান (পুরোহিত) লালমোহন মাটির ব্যখ্যা, “এখানেই তো আমাদের সঙ্গে বিরোধ। আমাদের সংস্কৃতি ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। এখনকার ছেলেরা ধামসা-মাদল বাজাতেই জানে না। আর বাপ-দাদার সংস্কৃতির প্রতি তাদের উৎসাহও নেই। ফুর্তি করার জন্য তারা ভোজপুরি কিংবা হিন্দি গান চালিয়ে নাচে। এটা আমাদের রীতি-নীতির বিরোধী।” যদিও গঢ়বা, পলামু, লাতেহারের মতো ঝাড়খণ্ডের প্রত্যন্ত জেলাগুলির গ্রামে অবশ্য আজ সরহুল পুজোয় লোকাচার মান হয়েছে আদিবাসী সংস্কৃতির প্রথা মেনেই। শহরের আদিবাসীদের মধ্যে নিজস্ব লোক সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে এক সময় প্রয়াত রামদয়াল মুণ্ডার উদ্যোগে রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ে আদিবাসী ভাষার আলাদা বিভাগ খোলা হয়েছিল। কিন্তু তা যে এই প্রজন্মের আদিবাসীদের মধ্যে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি তা এ দিন পরতে পরতে চোখে পড়েছে। আদিবাসীদের নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন রাঁচির বিশিষ্ট হিন্দি সাহিত্যক মহুয়া মাজি। তাঁর কথায়, “পেশার তাগিদে আদিবাসীরা গ্রাম থেকে শহরে চলে আসছেন। ফলে অনেকেরই গ্রামের সংস্কৃতির সঙ্গে কোনও যোগাযোগই নেই। তবুও সারাণ্ডার মতো গ্রামগুলিতে এখনও লোক সংস্কৃতি জিইয়ে রয়েছে। সংরক্ষণ না করলে তাও শেষ হয়ে যাবে।” |