সোমবার নয়, বাংলা ক্যালেন্ডার সংস্কারের ফলে এক দিন আগে রবিবারেই নববর্ষ বাংলাদেশে। কিন্তু এ বারের নববর্ষ একটু আলাদা সেখানে। রবিবারেও নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকায় বের হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। কিন্তু তার বিষয় হচ্ছে ‘রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ’। এই নববর্ষে বাংলাদেশের মানুষের চিন্তায়, মননে মিশে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। যার উৎসমুখ অবশ্যই শাহবাগ চত্বরের অবস্থান বিক্ষোভ।
ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখে জামাতে ইসলামির ডাকা হিংসাত্মক হরতালের দিনে মুখে স্লোগান আর হাতে মোমবাতি নিয়ে অবস্থান শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে শাহবাগ স্কোয়্যারে। তরুণ ব্লগারদের শুরু করা আন্দোলন অচিরেই পরিণত হয় গণজোয়ারে। ভেদাভেদ মুছে শাহবাগ চত্বর হয়ে উঠেছিল স্বাধীন মতামত প্রকাশের মঞ্চ। প্রতিবাদের মঞ্চ। বহুদিন ধরে জমা হওয়া ক্ষোভ উগরে দেওয়ার মঞ্চ। শাহবাগ দাবি তুলেছে, ফাঁসি হোক স্বাধীনতা-বিরোধী ঘাতকদের। নিষিদ্ধ হোক স্বাধীনতার বিরোধিতা করা মৌলবাদী জামাতে ইসলামি। |
রবিবার বাংলাদেশে নববর্ষ। ‘রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ’ হবে ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রার বিষয়।
শনিবার তারই প্রস্তুতি চারুকলা ইনস্টিটিউটে। উমাশঙ্কর রায়চৌধুরীর তোলা ছবি। |
শাহবাগকে ভয় পেয়েই আজ জোট বেঁধে নাশকতায় নেমেছে মৌলবাদীরা। কিন্তু এই শাহবাগই আবার এক সুরে বেঁধেছে সে দেশের অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে। শুরু হয়েছে পাল্টা প্রতিরোধও। সেই চেতনাই এ বার নববর্ষের উৎসবেও। ভোর থেকেই শুরু হয় উৎসব। মেয়েরা সাজেন খোঁপায় বেলি ফুলের মালা বেঁধে। সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ মুছে ফেলে বাঙালিয়ানার স্রোতে ভেসে যান সকলেই। ঢাকায় চারুকলা ইনস্টিউটের ছেলেমেয়েরা এখন ব্যস্ত মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতিতে। এ বারের শোভাযাত্রার সামনে দেখা যাবে খর্বকায় বীভৎস এক প্রাণীকে। সে ঘাতক রাজাকারের প্রতীক। তাকে তাড়া করে যাবে এক দৃপ্ত ষাঁড় ও শ্বেত কপোত। ষাঁড় বাংলাদেশের জনশক্তির প্রতিনিধি, কপোত শান্তির।
যুদ্ধাপরাধীদের চরম শাস্তির যে দাবি শাহবাগের আন্দোলনকারীরা তাঁদের অহিংস বিক্ষোভের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন, তার পিছনেও রয়েছে গভীর আবেগ। ১৯৭১-এ পাকিস্তান সেনার সহযোগী রাজাকার বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্তত ৩০ লক্ষ মানুষ। তাঁদের অনেকেই এখন জামাতে ইসলামির নেতা। কেউ কেউ রয়েছেন বিএনপি-রও মাথায়। প্রায় অর্ধ শতক পর এখন সেই ঘাতকদের বিচার শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে। বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা সাইফুল হকের কথায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও এই রাজাকাররা কৃতকমের্র জন্য ক্ষমা চাননি। স্বাধীনতার পরেও বহু মানুষ জামাতের হাতে খুন হয়েছেন। বহু নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন।
সাইফুল হকের কথায়, প্রতিটি আন্দোলনেরই কয়েকটি স্তর থাকে। শাহবাগের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। রাজাকার কাদের মোল্লাকে ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন দেয় ট্রাইব্যুনাল। তার প্রতিবাদেই শুরু হয় আন্দোলন। যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবির পাশাপাশি আন্দোলনের অন্যতম দাবি জামাতকে নিষিদ্ধ করুক সরকার। যুদ্ধাপরাধ এবং সন্ত্রাস ছড়ানোর অপরাধে। এই দাবিও উঠে আসছে, দেশে প্রতিষ্ঠিত হোক ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দাবি কি শুধুই তরুণদের? মুক্তিযোদ্ধা রাজা মিঞা জানান, “জামাত কিছু দিন আগে গ্রামে গ্রামে হুলিয়া জারি করেছিল, মহিলারা বাড়ির বাইরে যেতে পারবেন না। অনেকেই তা মানেননি। গ্রামের বহু মহিলা বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। কেউ কাজ বন্ধ করেননি।” এ-ও প্রতিবাদেরই ভাষা।
সাইফুল হক বোঝালেন, “বিদেশের ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ বা ‘তাহরির স্কোয়্যার’ বলুন, কিংবা দিল্লিতে গণধর্ষণ কাণ্ডের প্রতিবাদে ছাত্র আন্দোলন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষ সরাসরি আন্দোলনে নেমেছেন। কোনও রাজনৈতিক দলের মাতব্বরির প্রয়োজন হয়নি। মানুষও চাননি আন্দোলনগুলি ধামাধরা রাজনৈতিক দলগুলির নিয়ন্ত্রণে চলে যাক। শাহবাগও তা চায় না।”
শাহবাগ কিন্তু বাংলাদেশের সর্বংসহা জাতীয়তাবাদকে জাগিয়ে তুলেছে। নতুন বছরের আগমনী উৎসবেও তারই প্রতিচ্ছবি। |