পুস্তক পরিচয় ১...
জীবন দিয়ে গল্পকে যাপন
গল্পসমগ্র, রামকুমার মুখোপাধ্যায়। মিত্র ও ঘোষ, ৪০০.০০
‘আমাদের গ্রাম’ গল্পের নব সাক্ষর কথক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বামুনপাড়ার রামকুমারকে নিয়ে। যদিও রামকুমারের কথাতেই লেখা, লেখার জন্য দু’টি সিগারেট, একতাড়া বিড়ি আর একটি কালীমার্কা মদের বোতলও সে দিয়েছে নব সাক্ষরকে, কিন্তু কথা তো ছিল দু-বোতলের! অন্যটা বামুনের ভোগে লাগল কিনা, লেখাটা ঠিকঠাক নামে ছাপা হবে কিনা, এমন সব চিন্তা (পৃ. ৩৭৮)। ১৯৯৬-এ এই গল্প প্রথম বেরোতে বেরোতে রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখাজোকার বয়স দুই দশক পেরিয়ে গিয়েছে। যাত্রাপথে রামকুমার দেখেছেন, লেখক-নিরপেক্ষ বাস্তববাদী আখ্যানের পক্ষে দেশ-কাল, সমাজ-সংস্কার, প্রেম-অর্থনীতি, রাষ্ট্র-প্রশাসন, গ্রাম-শহর ক্রমশই বেমানান থেকে আরও বেমানান হয়ে পড়ছে। বয়ান যদি রামকুমারের বানানো হয়, তবে সেই নির্মাণের ভিতরকার নব সাক্ষরকে তেমন জীবনসম্মত দেখাচ্ছে না। বরং তেমন বানিয়ে তোলা বাস্তবের অসঙ্গতিকে স্পর্শ করতে প্রয়োজন পড়ছে নব সাক্ষরের নিজস্ব বয়ানের— যেন তার কথক রামকুমার নন। মেনে নিতে হচ্ছে, ‘আমাদের গ্রাম’-এর পরিবর্তে ‘আমাদের পাড়া’ শিরোনামটি আরও মানানসই হতো, অতখানি মান্যতাই অনুপুঙ্খের প্রাপ্য। অর্থাৎ লেখকের এত দিনের শিল্পসঙ্গত সব সৃজন যেন নিজেদের ভিতরকার আকাঁড়া সত্যিগুলোকে নিয়ে খানিকটা বিপর্যস্ত, দিশেহারা। তাই চারণে প্রান্তরে-র ঔপন্যাসিক রামকুমার মুখোপাধ্যায়কে পৌঁছতে হয়েছে দুখে কেওড়ার মতো ব্রাত্যজনের দুয়ারে, নঙ্গরচন্দ্রের মতো পত্রলেখকের কাছে। দুখে কেওড়া (২০০২) বা ভবদীয় নঙ্গরচন্দ্র-র (২০০৬) প্রস্তুতিপর্বকে পাঠক শনাক্ত করতে পারেন আলোচ্য গল্পসমগ্র-র ‘আমাদের গ্রাম’, ‘মডেল’ অথবা ‘সম্পাদকের প্রতিবেদন’-এ। তবে কি সাহিত্যিক চৌহদ্দিটা অবান্তর হয়ে গেল গম্ভীর সত্যভাষণ আর নির্জলা কল্পনার টানাপড়েনে?
অথচ সেই চৌহদ্দির মধ্যে জীবনপ্রবাহের কত বিচিত্র বিন্যাসই না তৈরি করেছেন রামকুমার। অতি তুচ্ছ জীবিকা থেকে গড়ে উঠতে পারে জীবনের অঙ্গীকার, বাঁচা-মরার প্রান্তদেশে দাঁড়িয়ে মরিয়া মানুষ শনাক্ত করতে পারে আপাত-অপাঙক্তেয় জীবনের উদ্বৃত্তকে, আবার রুজি আর জীবনের নিত্যকার দ্বন্দ্ব সাবেকি পুরাণ ভেঙে বানাতে পারে নতুন পুরাণ। নতুন পুরাণের রূপকথা আর আধুনিক বাজারবিশ্বের অ-রূপকথার মধ্যে ভেদরেখা টানা যায় না। আসলে রামকুমারের গদ্য ছবি লিখতে পারে। বিন্যাসের সেই মায়াময়তায় সাবেককেলে রূপকথা কথনের অছিলায় তিনি বলে দেন সাম্প্রতিকের দীর্ণ জীবনকথাটি। ‘গোষ্ঠ’-র (১৯৮০) বাগালবালক লক্ষ্মণ পোয়াতি ভেড়াকে প্রসব করানোর আগে তার বাঁটে মুখ দিয়ে দুধ খায়। আত্মহত্যা করতে গিয়ে মরাঘুঘু নিয়ে বাড়ি ফেরে গৃহস্থ (‘জ্যৈষ্ঠ ১৩৯০, ঘুঘু কিংবা মানুষ’, ১৯৮০)— পাখির মাংস যখন নাগালে, তখন তো আছে রাতের খাবার। ‘বনমালীর পৃথিবীতে ফেরা’ (১৯৮৫), ‘হাউসে’ কিংবা ‘শাঁখা’ (১৯৯৩), ‘রঙ’ (১৯৯৪), সবই তো আপাততুচ্ছ জীবনযাপনে নিহিত অপার জীবনীশক্তিকে, নিদারুণ অসহায়তায় মিশে থাকা মরিয়া অগ্রগমনের সাধকে, সেই সাধের সাধ্যকে এবং অসাধ্যকেও পাঠকের সামনে নিয়ে আসে। এই বহনের ভিতরে কোনও বিচার নেই, আছে মানবিক ব্যথা।
গল্পসমগ্র-র ভূমিকার বিকল্পে ‘গাঁ-ঘরের কথা’য় রামকুমার বুঝিয়ে দেন, গল্প লেখার থেকে অনেক বড় কথা হল, জীবন দিয়ে গল্পকে যাপন করা। তাই বাঁকুড়ার গেলিয়াগ্রামের শৈশববাল্যের স্মৃতিমেদুরতায়, শিক্ষার্থী এবং কর্মজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতায়, দায়ভার সংশ্লিষ্ট ভ্রমণে, সিদ্ধান্তে, সিদ্ধান্তহীনতায় রামকুমার গ্রামের গল্প— নগরের কাহিনির বিভাজনটিকে এলোমেলো করে দিতে পারেন। ‘গোষ্ঠ’ থেকে সূচনা বলেই হয়তো কলকাতা বইমেলার আগুনে পোড়া আমগাছের গল্পে এমনকী ভবানীপুরের সিদ্ধার্থ অ্যাপার্টমেন্ট ভেঙে পড়ার বিন্যাসে (‘পেঁচা’ ১৯৯৭, ‘ধ্বংসস্তূপে প্রেমালাপ’ ১৯৯৯) পরম প্রশান্ত ভঙ্গিতে পৌঁছতে পারেন। ওই প্রশান্তিকে ভেঙে যদি অস্থিরতাকে পড়তে চান পাঠক, তবে তিনি দেখতে পাবেন, রামকুমারের সব গল্পই আসলে প্রকৃতির কাছে, জীবজগতের কাছে লেখকের ঋণস্বীকারের গল্প।
তাই মানুষের শিকড় সন্ধান আর কৃতী জীবিকায় ভরপুর সফল সংসারযাত্রা কখনও একমুখী কার্যকারণে বাঁধা পড়ে না। ‘আকর্ষণ বিকর্ষণ’-এর (১৯৮৮) কলকাতা-দিল্লিফেরত সফল কালীধন যে-গ্রামে বাস করতে আসেন, সেই গ্রামটাকেই খুঁজে পান না। পুরনো গল্পে নতুন টানটোন দেওয়া তাঁর অনেক দিনের অভ্যাস। ‘পেয়ারাবুড়ো পান্তাবুড়ি’ (১৯৭৯) থেকে ইশপের আদ্যিকেলে বয়ানে সাম্প্রতিকের অনটন-দীর্ণতা মিশিয়ে ‘কাক ও কলস’ (১৯৯৬), সর্বত্রই তাঁর আয়োজন যেন রূপকথার অছিলায় অন্য কথা বলার। মিছিলের পরে উপন্যাসে (১৯৯৮) দলছুট পাঁচজন রাতের ব্রিগেডে নিজের জীবনকথা অন্যকে শোনায়। আঁধার ব্রিগেডে গাছপালা, পাখপাখালি, সাপখোপ হয়ে ওঠে চারটি উক্ত এবং একটি অনুক্ত কাহিনির উদ্গ্রীব এমনকী সরব শ্রোতা। সেই জীবনকথার সুবাদে রামকুমার আবাহন করেছিলেন বাংলার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পণ্যের প্রবাহে বনের ময়ূরকে বিসর্জন দিয়েও বানানো গেল না যথার্থ নগর। তারই ধারাবাহিকতায় দলছুটদের আত্মকথন জুড়ে অসঙ্গতি আর স্ববিরোধ। কত দিন আগে গ্রামের মোট বওয়া বাঁকুচাদ ভয়ে ভয়ে উত্তর দিচ্ছিল, শহুরেবাবুর প্রশ্নের। পরের প্রশ্ন যদি আরওই দুর্বোধ্য হয় (‘বাঁকুচাঁদের গৃহস্থালি’, ১৯৭৯)? অত পুরনো বাঁকুর পক্ষেও যেন নিশান কাঁধে রাতের ব্রিগেডে দলছুট হয়ে যাওয়া সম্ভব, এমনই ছিল মিছিলের পরে-তে রূপকথা আর অ-রূপকথার মেলবন্ধন।
বাস্তবের সন্ধানে রূপকথার সেই ব্রতযাত্রা সম্ভবত লেখককে অন্য কোনও কথকতার জন্য অস্থির করে তোলে। মিছিলের পরে উপন্যাসটি লেখা এবং গ্রন্থিত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে চণ্ডীমঙ্গল-এর আখেটিক খণ্ডের নির্বাচিত অংশের অনুবাদক ই বি কাওয়েলকে নিয়ে ‘পশ্চিম-পূর্ব’ (১৯৯৭) গল্পটি লেখেন রামকুমার। এ গল্প বহন করে বহু দিন আগে লেখা ‘নব রত্নাকর উপাখ্যান’-এর (১৯৯১) প্রক্ষেপ। এখানেই সম্ভবত সূচনা তাঁর সাম্প্রতিকতম উপন্যাস ধনপতির সিংহলযাত্রা-র (২০১০) প্রস্তুতির, যার টুকরো টুকরো প্রমাণ মেলে আলোচ্য সমগ্রটিতে। ‘পশ্চিম-পূর্ব’ ছাড়াও ‘কালিদহ’ (২০০২)। আবার, বিজ্ঞাপনের আবরণে ঢেকে যাওয়া আমাদের মুখ যখন তাঁর গল্পের বিষয়, তখন লেখক যেন চলে যান আড়াল থেকে আরও আড়ালে (‘কে হবেন কোটিপতি’ ২০০০)। আজকের লেখকের জন্য এই অন্তরালটুকুই কি খুঁজছিলেন রামকুমার তাঁর সাহিত্যিক পরিক্রমায়? কবিকঙ্কণ মুকুন্দের চণ্ডীমঙ্গল পাঠ হয়তো উপনিবেশ-পূর্ব নিজেকে চিনতে চাওয়ার দায় থেকেই— শ্রেষ্ঠ গল্প-র ভূমিকায় লিখেছেন তিনি।
উপনিবেশ-পূর্ব জীবনচর্যার অনুপুঙ্খকে তো আজ উপনিবেশের প্রজ্ঞা ও বিভ্রান্তি বাদ দিয়ে, স্বাধীনতার ভঙ্গুর আবর্ত বাদ দিয়ে খোঁজা অসম্ভব। ‘পরিক্রমা’-র (১৯৯৪) সেই শতক পার করা বৃদ্ধা আবিশ্ব শাখাপ্রশাখা মেলে অতীতের স্বপ্ন দেখে, ভাবে এই বুঝি ভবিষ্যৎ। কলাগাছ হাতে সেই বৃদ্ধা, মুখোমুখি চতুর্থ প্রজন্মের হস্তিশাবক। এই অসামান্য চিত্রটি তো লেখককেই ভাঙতে হয়। না-হলে এগোতে পারে না তাঁর সাহিত্যিক যাত্রা। রামকুমার যখন চণ্ডীমঙ্গল-এর পাঠকসত্তার অন্তরালে নিজের আখ্যানকার ভূমিকাটিকে গৌণ রাখতে চান, তখনই তো চণ্ডীকাহিনির বণিকখণ্ড সিংহল যাত্রার ভাষান্তরে মূর্ত হয়। শিক্ষিতের গবেষণার নিরর্থ বুঝতে আর বোঝাতে ‘মানুষের ইতিহাস’-এর (১৯৯৩) মতো কাহিনি তিনি লিখেছেন। ‘পরিক্রমা’য় পাঠক দেখেছেন ওই শতক-সিদ্ধা বৃদ্ধার শাশুড়িকে। বুড়ি যখন ভবিষ্যৎ ভেবে অতীতের স্বপ্ন দেখে, তার কবেকার না-পাওয়া টিয়া রং-বেনারসি-ভেসে-যাওয়া ঘোলা জলের স্রোতে বৃদ্ধার দীর্ঘ অতীতের থেকেও দীর্ঘতর কোনও অতীতের কল্পনা কি পেয়ে বসে লেখককে? ওই ঘোলা জলের স্রোতের সামনেই কি উপনিবেশ-পূর্ব নিজের জন্য রামকুমারের প্রথম সচেতন বিরহের বোধ?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.