এক যে ছিল বৈশাখ
রস্বতী পুজোই নাকি বাঙালির জাতীয় প্রেম দিবস। ইংরেজ-নবিশরা ইদানীং একেই বাঙালির ভ্যালেন্টাইন ডে বলে গদগদ মল-যাত্রায় ব্যস্ত হয়ে থাকেন। কিন্তু ষাট-উত্তীর্ণ কটাই জানেন তাঁর ভরা সংসারের হাল বুঁচির ধরা হত না পয়লা বৈশাখ না থাকলে।
তখন শুধুই সরকারি চাকরি, পাড়া আর মহল্লার যুগ। কর্তা রোজ বাজার যেতেন। কাপড়ের দুই থলে। একটা ছোট। তাতে ‘ভাগা’-র হিসাবে কেনা মাছ। বেশির ভাগ থলের রঙই ছিল সাদা। তলাটা বহুদিনের মাছের রক্ত শুকিয়ে কালো আর মাড় দেওয়া কাপড়ের মতো শক্ত। থাকত বাঁ হাতে। আমিষ যে! আর একটা একটু বড়। তার থেকে উঁকি দিত শাকের আঁটি। কর্তার চ্যালেঞ্জ ছিল বাজারের শেষে না-কাটা পাঁউরুটি আর কলাপাতায় মোড়া এক টুকরো ‘মাকম’ না গলিয়ে বাড়ি ফেরা।
সকালের ‘টিপিন’ ছিল উনুনের সেঁকা পাঁউরুটি, উপরে হাল্কা মাকম আর চিনি। তা-ই তখন অমৃত। কোথায় তখন রেফ্রিজারেটর, মল বা কার্ড ঘষে দোকানে দোকানে জিনিস কেনার ব্যবস্থা বা নামে নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট! দিনের হিসেব তখন দিনেই চোকাতে হত।
আর ছিল মাসকাবারি। প্রতি মাসের প্রথম দিনটিতে সকাল থেকে তৈরি হত লিস্টি। খাতা থেকে ছেঁড়া পাতায় গৃহকর্ত্রীর করে দেওয়া তালিকা। অফিস থেকে ফিরেই মাসপয়লা মুদির দোকান ছোটার ধুম। তখনও ‘প্রভিসন স্টোর’ শব্দটা বাঙালির অভিধানে ঢোকেনি।
তা দৈনন্দিন বাজারে, বা বাসের উদ্বাহু যাত্রায় আলাপ ওই মাসকাবারিতেই গভীরতা পেত। সাদা চাদরের উপর ডেস্ক সামনে নিয়ে বসা দোকানের মালিক প্রত্যেক খদ্দেরকে নামেই চিনতেন। জানতেন কার কোন পাড়া।
অলংকরণ: অনুপ রায়
ওই লিস্ট দেওয়ার পরেই হাঁফ ছেড়ে মাসপয়লার তাতানো পকেটের আঁচে উদ্বুদ্ধ বাবুরা একটু আয়েস করে গরম চায়ে আর বিড়িতে ফুঁ দিয়ে আড্ডা দিতেন নানান বিষয়ে। থাকত কটাই বা বুঁচির পড়াশোনা অথবা সোনাপিসির অপারেশন পিজিতে করাতে গেলে বাসের সেনবাবুই যে আসলে মুশকিল আসান সে তথ্যও। তৎকালীন বঙ্গ সমাজের ‘গুগল’ ছিল এই মহল্লার বাজার আর মুদির দোকান। আর অবশ্যই রবিবারের ‘রোয়াক’ বা রকের আড্ডা। বাঙালির এই প্রাত্যহিকতা জমতে জমতে তাল হয়ে পড়ত ওই পয়লা বৈশাখেই। ওই দিনই যাচাই হত দোকানের ‘ব্র্যান্ড লয়্যালটি’। জাবেদা খাতায় নাম উঠছে। নামকে ওয়াস্তে কেনাকাটা। বছরের প্রথম দিন লক্ষ্মী এলে সারা বছর থাকবেন। কে কোন দোকানে যাচ্ছেন, কতটা সময় কাটাচ্ছেন তার মানসিক হিসাব চলছে আগামী দিনের ব্যবসার অঙ্কে। আর অবশ্যই থাকবে সেই বিবেকানন্দ, শ্রীরামকৃষ্ণ বা দেবতার ছবি-সহ ক্যালেন্ডার।
তখন বসার ঘরওয়ালা বাঙালি তো কোটিকে গুটিক। ওই শোয়ার ঘরেই ঠাকুরের কুলুঙ্গির পাশে পাঁপড় হয়ে যাওয়া লক্ষ্মীর ছবিওয়ালা পুরনো ক্যালেন্ডার ঘোষণা করত কর্তার পছন্দের দোকানের নাম।
হালখাতা হত কটাইদের ভবিষ্যৎ জীবনেরও। দশমীর প্রণামটা ছিল নৈর্ব্যক্তিক, যান্ত্রিক। দলে দলে অভিবাদনের দিন। পুজোর ভিড়ের ল্যাজের আছাড়। পয়লা বৈশাখ ছিল পারিবারিক। অনেক বেশি ব্যক্তিগত। পাট পাট চুল। ও পাড়ার বাবলু স্কুলের বন্ধু। তারই সঙ্গে বেপাড়ার কটাই ঢুকত বুঁচির বাড়িতে। ঢিপ করে প্রণাম।
“বাবলুর সঙ্গে এসেছিল ওই ছেলেটা কে গো?” পরের দিন সকালে কর্তার প্রশ্ন।
“ওমা! ও তো তোমার বাসের বন্ধু কেশববাবুর ছেলে গো! সোনার ছেলে। এ বার প্রেসিডেন্সিতে ঢুকল। বাবলু বলে ও নাকি মুখে মুখে অঙ্ক করে।”
এ ব্যাপারে তখন তো কর্তার কথাই শেষ কথা। বাবলুর মারফৎ কথা পৌঁছল কটাইয়ের কানে। ব্যস। সেই পঁচিশে বৈশাখেই বাবলু দিদি ও বুঁচিকে নিয়ে রবীন্দ্র সদন। কটাইও হাজির।
এর পরে কেশববাবু তো অস্থির ছেলের প্রশংসা শুনতে শুনতে। তত দিনে বাবলুর দিদি বুঁচিকে নিয়ে কটাইয়ের বাড়ি ঘুরে গিয়েছে। কেশববাবু তার বিন্দুবিসর্গ জানেন না। “তুমি তো মহল্লার পপুলার মাসিমা। রামবাবুর মেয়েটা কেমন?”
“তুমি জানলে কী করে? রামবাবু বলেছেন বুঝি? তোমার ছেলে তো দেখি তোমার থেকে আরও এক কাঠি উপরে। আগেই ব্যবস্থা করে রেখেছে। যেমন পড়াশোনায়, তেমন গানে। মনটা খুব ভাল গো। এ বার লেডি ব্রেবোর্নে ঢুকেছে। আমি কিন্তু ছেলেকে বলে দিয়েছি ওর সঙ্গে ঝগড়া করলে আমি দেখে নেব! হু।”ঁ নিয়োগীর ছেলে এখন দোকান সামলান। দোকানের সামনে ফ্লেক্সে বহুজাতিকের বিজ্ঞাপন-সহ দোকানের নাম। বাবার ডেস্ক বিদায় নিয়েছে। দরজায় কোন কোন ব্যাঙ্কের কার্ড গ্রহণ করা হয় তার ঘোষণা। কটাই ওরফে সুমন্ত্র মহল্লাতেই বহুতলে তিনটে ফ্ল্যাট নিয়ে একটা ফ্ল্যাট বানিয়ে থাকেন। বিদেশি ব্যাঙ্কের বড় কর্তার পদ থেকে অবসর নিয়ে এখন কনসালট্যান্ট হিসাবে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান। গিন্নি বুঁচি ওরফে ভাস্বতী শিক্ষাজগতের জাঁদরেল ব্যক্তিত্ব। দু’জনের ঝুলিতেই বিদেশি ডিগ্রি। ছেলে মেয়েরাও একই পথে হাঁটছে। এই পয়লা বৈশাখেও নিয়োগীর ছেলে ক্যালেন্ডার করবেন। লিস্ট বানাচ্ছেন নিয়মিত খদ্দেরদের। মাসকাবারির অর্ডারের সঙ্গে পাঠিয়ে দেবেন ক্যালেন্ডার, মিস্টির প্যাকেট থাকবে। ঐতিহ্য। কী আর করা। কিন্তু বেশির ভাগের সঙ্গেই শুধু মৌখিক পরিচয়।
তলার ফ্ল্যাটে সে দিন এক জন মারা গেলেন। কটাই মুখ চিনতেন। মৃত্যুর খবর শুনলেন সিকিউরিটির কাছ থেকে। ভেবেছিলেন যাবেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলান। পাছে ব্যক্তিগত মুহূর্তে অপরিচিত প্রতিবেশীর উপস্থিতি মানতে না পারেন শোকগ্রস্ত পরিবার। সোসাইটির আয়োজন করা শোকসভাতে এক বার ঘুরে আসবেন।
বুঁচি এখনও নিয়োগীর দোকান থেকেই মাসকাবারি আনান। ফোনে অর্ডার দেন। বহু দিনের আলাপ। তাই চেক ধরান। কিন্তু নিয়োগীর নাতি কী করে তা জানেন না। বাংলা ক্যালেন্ডার এখনও টাঙান। কিন্তু ঢাউস রান্নাঘরে, ফ্রিজের গায়ে ম্যাগনেট দিয়ে। আগের বছরেরটা কাজের লোকই ফেলে দেয়।
‘বৈশাখে দেখা হল দু’জনার’ দিনও শেষ। অত কৌশল করে এই মোবাইলের যুগে আর কেউ প্রেম করে না। গ্লোবালাইজড দুনিয়ায় পাড়া এখন শুধু প্রতিবেশ। পয়লা বৈশাখ আর ‘হ্যাপেনিং’ নয়। নিয়োগীরা এখন চিন্তায়। নতুন দুনিয়ায় পুরনো দোকানের ‘ব্র্যান্ড লয়্যালটি’ কী কৌশলে বাড়াবেন?
ফেসবুকে?
“বাবলুর সঙ্গে এসেছিল ওই ছেলেটা কে গো?” পরের দিন সকালে কর্তার প্রশ্ন।
“ওমা! ও তো তোমার বাসের বন্ধু কেশববাবুর ছেলে গো! সোনার ছেলে। এ বার প্রেসিডেন্সিতে ঢুকল। বাবলু বলে ও নাকি মুখে মুখে অঙ্ক করে।”
এ ব্যাপারে তখন তো কর্তার কথাই শেষ কথা। বাবলুর মারফৎ কথা পৌঁছল কটাইয়ের কানে। ব্যস। সেই পঁচিশে বৈশাখেই বাবলু দিদি ও বুঁচিকে নিয়ে রবীন্দ্র সদন। কটাইও হাজির।
এর পরে কেশববাবু তো অস্থির ছেলের প্রশংসা শুনতে শুনতে। তত দিনে বাবলুর দিদি বুঁচিকে নিয়ে কটাইয়ের বাড়ি ঘুরে গিয়েছে। কেশববাবু তার বিন্দুবিসর্গ জানেন না। “তুমি তো মহল্লার পপুলার মাসিমা। রামবাবুর মেয়েটা কেমন?”
“তুমি জানলে কী করে? রামবাবু বলেছেন বুঝি? তোমার ছেলে তো দেখি তোমার থেকে আরও এক কাঠি উপরে। আগেই ব্যবস্থা করে রেখেছে। যেমন পড়াশোনায়, তেমন গানে। মনটা খুব ভাল গো। এ বার লেডি ব্রেবোর্নে ঢুকেছে। আমি কিন্তু ছেলেকে বলে দিয়েছি ওর সঙ্গে ঝগড়া করলে আমি দেখে নেব! হু।”
নিয়োগীর ছেলে এখন দোকান সামলান। দোকানের সামনে ফ্লেক্সে বহুজাতিকের বিজ্ঞাপন-সহ দোকানের নাম। বাবার ডেস্ক বিদায় নিয়েছে। দরজায় কোন কোন ব্যাঙ্কের কার্ড গ্রহণ করা হয় তার ঘোষণা। কটাই ওরফে সুমন্ত্র মহল্লাতেই বহুতলে তিনটে ফ্ল্যাট নিয়ে একটা ফ্ল্যাট বানিয়ে থাকেন। বিদেশি ব্যাঙ্কের বড় কর্তার পদ থেকে অবসর নিয়ে এখন কনসালট্যান্ট হিসাবে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান। গিন্নি বুঁচি ওরফে ভাস্বতী শিক্ষাজগতের জাঁদরেল ব্যক্তিত্ব। দু ’জনের ঝুলিতেই বিদেশি ডিগ্রি। ছেলে মেয়েরাও একই পথে হাঁটছে।
এই পয়লা বৈশাখেও নিয়োগীর ছেলে ক্যালেন্ডার করবেন। লিস্ট বানাচ্ছেন নিয়মিত খদ্দেরদের। মাসকাবারির অর্ডারের সঙ্গে পাঠিয়ে দেবেন ক্যালেন্ডার, মিস্টির প্যাকেট থাকবে। ঐতিহ্য। কী আর করা। কিন্তু বেশির ভাগের সঙ্গেই শুধু মৌখিক পরিচয়।
তলার ফ্ল্যাটে সে দিন এক জন মারা গেলেন। কটাই মুখ চিনতেন। মৃত্যুর খবর শুনলেন সিকিউরিটির কাছ থেকে। ভেবেছিলেন যাবেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলান। পাছে ব্যক্তিগত মুহূর্তে অপরিচিত প্রতিবেশীর উপস্থিতি মানতে না পারেন শোকগ্রস্ত পরিবার। সোসাইটির আয়োজন করা শোকসভাতে এক বার ঘুরে আসবেন।
বুঁচি এখনও নিয়োগীর দোকান থেকেই মাসকাবারি আনান। ফোনে অর্ডার দেন। বহু দিনের আলাপ। তাই চেক ধরান। কিন্তু নিয়োগীর নাতি কী করে তা জানেন না। বাংলা ক্যালেন্ডার এখনও টাঙান। কিন্তু ঢাউস রান্নাঘরে, ফ্রিজের গায়ে ম্যাগনেট দিয়ে। আগের বছরেরটা কাজের লোকই ফেলে দেয়।
‘বৈশাখে দেখা হল দু’জনার’ দিনও শেষ। অত কৌশল করে এই মোবাইলের যুগে আর কেউ প্রেম করে না। গ্লোবালাইজড দুনিয়ায় পাড়া এখন শুধু প্রতিবেশ। পয়লা বৈশাখ আর ‘হ্যাপেনিং’ নয়। নিয়োগীরা এখন চিন্তায়। নতুন দুনিয়ায় পুরনো দোকানের ‘ব্র্যান্ড লয়্যালটি’ কী কৌশলে বাড়াবেন?
ফেসবুকে?




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.