বেআইনি জিনিসকে কেমন করিয়া আইনসম্মত করিয়া লইতে হয়, কলিকাতা পুরসভায় তাহার একটি মোক্ষম প্রশিক্ষণ শিবির আছে। বিভিন্ন ওয়ার্ডে যে সব বহুতল বাড়ি উঠিতেছে, তাহাদের একটা বড় অংশই বেআইনি, অর্থাৎ অনুমতি-বহির্ভূত। হয়তো সেই বে-আইনি নির্মাণ সাঙ্গ হইলে পুরসভাকে জরিমানা দিয়া বাড়ি ‘আইনসম্মত’ করিয়া লওয়ার একটি ব্যবস্থা আছে। কলিকাতায় নাকি এ ধরনের অন্তত তিন হাজার বাড়ি প্রতি বছর আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘আইনসম্মত’ হইতেছে। পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম জানাইয়াছেন, দীর্ঘ কাল যাবৎ চলিয়া আসা এই ব্যবস্থাটি বন্ধ করিবার কথা ভাবিতেছে সরকার। কী কী আইন সংশোধন করা প্রয়োজন, তাহা দেখিবার জন্য কমিটি গঠন করা হইয়াছে।
আইনের ফাঁক গলিয়া যথেচ্ছাচার করিবার প্রবণতাটি অতঃপর কমিবে কি না, তাহা পরের প্রশ্ন। প্রথম প্রশ্ন হইল, কেন এই অরাজকতা? ইহা কি মানসিকতার সমস্যা? এই ধরনের বেআইনি বহুতলগুলিই নানা দুর্ঘটনায় পড়ে, অগ্নিসংযোগের কবলেও গ্রস্ত হয়। তথাপি কেন এ ভাবে জরিমানার বিনিময়ে আইনভঙ্গকারীদের ছাড়িয়া দেওয়া? কেন বেআইনি নির্মাণ নির্মম ভাবে ভাঙিয়া দেওয়া হয় না? আইন না-মানার প্রবণতাকে প্রশ্রয় দিবার, বস্তুত দস্তুর করিয়া তোলার ফলে অন্যান্য ক্ষেত্রেও অরাজকতার ছড়াছড়ি। প্রয়োজনীয় পারমিট ছাড়াই স্কুলপড়ুয়াদের যাতায়াতের যানগুলি নিয়মিত পথে বাহির হইতেছে, দুর্ঘটনায়ও পড়িতেছে। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও শহরের অটো-রিকশয় ভাড়া নির্দিষ্ট করিবার ও মিটার লাগাইবার তাগিদ পরিবহণ মন্ত্রকের নাই। শহরের যাবতীয় ফুটপাথ ও রাস্তা বেআইনি ভাবে জবরদখল হইয়া যাওয়ার পর দখলদারদের ‘আইনি স্বীকৃতি’ দিতে সরকার উদ্যোগী। ফলে পথচারীদের আর কোনও দিনই ফুটপাথে চলার অধিকার ফিরিয়া পাওয়ার সম্ভাবনা নাই।
যে কোনও ক্ষেত্রেই আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া পার পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হইতে থাকিলে আইনের শাসনই যে দুর্বল হইয়া পড়ে। প্রশাসন তথা সরকার যদি সর্ব বিষয়ে শৈথিল্য দেখায়, আইন প্রয়োগে কঠোর না হয়, তবে সুশাসন কায়েম হইবে কী রূপে? পশ্চিমবঙ্গে আইনের শাসন দীর্ঘ কাল ধরিয়াই অন্তর্হিত। ‘পরিবর্তনের’ পরেও আসলে কিছু বদলায় নাই। সব আগের মতোই চলিতেছে। ফিরহাদ হাকিমের বক্তব্যে এক দিকে যেমন খানিক আশার সঞ্চার হইতেছে, অন্য দিকে আশঙ্কাও প্রবল আর পাঁচটি সদিচ্ছার ন্যায় বর্তমান প্রচেষ্টাও বেনিয়মের মরুপথে দিশা হারাইবে। নূতন আইন হয়তো প্রণীত হইবে, কিন্তু অবিলম্বে সেই আইনে ছিদ্রপথও আবিষ্কৃত হইবে। পুরাতন বেনিয়মগুলি নূতন আইনের নূতন ছিদ্রপথে স্বমহিমায় টিকিয়া থাকিবে। আশঙ্কাটি যে অমূলক নহে, তাহা প্রমাণ করিবার দায়িত্ব কলিকাতা পুরসভার, রাজ্যের পুরমন্ত্রীর। উভয়ই যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইচ্ছা ও নির্দেশাধীন, মূল দায়িত্ব তাঁহাতেই বর্তায়। পরিবর্তন যে শুধু স্লোগানেই সীমাবদ্ধ নহে, তাহা প্রমাণিত হউক। |