পেটের টানে ফিকে হচ্ছে গম্ভীরার সুর
চৈত্র মাস পড়তে না পড়তেই ‘শিব পার (পার্বতী) ভক্তি রে’ ধ্বনি তুলে ছেলে-ছোকরার দল গ্রামের বাড়িগুলিতে উপস্থিত হয়। পরনে তাদের সাদা ধুতি ও গেঞ্জি। হাতে থাকে একটি ঘটি। তারা বাড়িতে ঢোকা মাত্রই লোকেরা উঠোনে এসে জড়ো হয়। ঢাক বাজতে থাকে। শুরু হয় গমীরা খেলা। ছেলের দল ধরে গান‘এক চাষে করে ভুঁইখান, দুইয়ো চাষো মই। তাও না ক্যানে উঠতি নাচায়, ক্যামনা দুববা বই’।
গমীরা খেলার দিন ফুরিয়েছে। জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দার্জিলিংয়ের তরাই অঞ্চলে গাজন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত ‘গমীরা খেলা’ গ্রামেগঞ্জে আজও জনপ্রিয় হলেও যোগদানকারীদের সংখ্যা কমে এসেছে। ভাটা পড়েছে গান রচনার ক্ষেত্রেও।
গমীরা খেলায় গান আবশ্যিক। গানের সঙ্গে নানা অঙ্গভঙ্গি করে চলতে থাকে নাচও। উত্তরবঙ্গের প্রায় প্রতিটি জেলায় মূলত রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মভিত্তিক এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। গমীরা খেলায় গানের চাহিদা বা আকর্ষণ কি বাড়ছে? উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক দীপককুমার রায় বলেন, “গ্রামের মানুষদের কাছে এর চাহিদা থাকলেও আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের কারণে গ্রামীণ মানুষদের অংশগ্রহণ কমে এসেছে। সে জন্যই গান রচনাও কমে এসেছে।” জলপাইগুড়ির বেরুবাড়ি অঞ্চলের গমীরা খেলার গানের গীতিকার রসনা রায় জানান, “এলাকাতে আগে বেশ কিছু দল থাকলেও এখন গমীরা খেলার দল হাতে গোনা। ছেলেরা আগে উৎসাহ নিয়ে আসত। ওদের আগ্রহ দেখে গান লিখে দিতাম। এখন হাতে-গোনা যে দু’-একটি দল রয়েছে, তারা পুরোনো গানগুলোই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গায়।”

গম্ভীরা নাচের দল।—নিজস্ব চিত্র।
মূলত তান্ত্রিক ক্রিয়াচার, লৌকিক রীতিনীতি ও রঙ্গরস এই গানের বিষয় হয়ে আসে। কৃষিকে কেন্দ্র করে লেখা গান, সামাজিক ব্যাপার কিংবা গ্রামে খরা, বন্যা বা কোনও বিরল ঘটনা ঘটলে গান তৈরি হয়। কোচবিহারের মেখলিগঞ্জের গমীরা খেলার দলের অমল রায়, রঞ্জিত রায়, দুলাল বর্মনদের অভিজ্ঞতা হল, “মেচেনি খেলা, ভাওয়াইয়া বা পালটিয়া খেলার জন্য নানা উৎসব-অনুষ্ঠান থেকে ডাক এলেও গমীরা খেলার জন্য আর আমাদের কেউ ডাকে না। তাই আগে দলে প্রায় বারো-পনেরো জন থাকলেও এখন মাত্র পাঁচ জনে এসে ঠেকেছি।”
ময়নাগুড়ির বাসিন্দা লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ ও সংগ্রাহক দীনেশ রায় জানান, এই খেলায় অংশগ্রহণকারী ছেলে-ছোকরারা কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া যোগদানকারীদের নানা নিয়মনিষ্ঠার মধ্য দিয়ে চলতে হয়, সে কারণে গমীরা খেলার চলও কমে এসেছে। গীতিকাররা এখন আর আগ্রহ দেখান না। পুরোনো গানই গাওয়া হয়।
পূর্ববঙ্গ থেকে আগত কোচবিহারের নীলকমল সরকার, ফুলচাঁদ বাড়ুই কিংবা বাগডোগরার গোকুল দেবনাথরা দল বেঁধে গাজন উপলক্ষে ‘শিবকালী খেলা’ দেখান। শিবকালী খেলার গানের রচয়িতা আটাত্তর বছর বয়সি হরেন সরকার জানান, “শিবকালীতে যে গান গাওয়া হয়, তার কথায় বৈচিত্র কম। শিব, কালী, দুর্গার বর্ণনা বা মাহাত্ম্য প্রচারই গানের মুখ্য বিষয়। বছরে মাত্র এক বার এই সময়ে এই শিবকালী খেলা দেখানো হয়। গ্রামের ছেলেরা সংস্কার বা বিশ্বাস থেকেই এটি পালন করে আসছে। তবে আগে বেশ কিছু ছেলের দল যে এতে বের হত, সংখ্যা কমতে কমতে এখন তা প্রায় উঠে যাওয়ার মুখে। সে জন্য গান লেখা এখন প্রায় ছেড়েই দিয়েছি।”
গমীরা দলের দুলাল, বিমল, রঞ্জিত কিংবা শিবকালী দলের নীলকমল, গোকুল দেবনাথ বা ফুলচাঁদরা জমিতে চাষ-আবাদ করার ফাঁকে ফাঁকেই ঝালিয়ে নেন গল্পগুলি। অধ্যাপক দীপককুমার রায় জানান, ‘‘গমীরা শব্দটির উৎপত্তি ‘গম্ভীর’ শব্দ থেকে। ‘গম্ভীরনাদ’ শিবের অপর নাম। তার থেকেই এসেছে ‘গমীরা’। এই অঞ্চলে ‘চোরচুন্নি’ বা ‘মেচেনি’ খেলার মতো গমীরা খেলাও লোকনাট্যের একটি আঙ্গিক। এতে নাটকীয়তা যথেষ্টই থাকে। গানের কথায় নাটকের নানা ঘটনার কথা উঠে আসে। গ্রামীণ মানুষ তার প্রাণের কথা খুঁজে পায়। জনমানসে তার চাহিদা রয়েছে।”
পুরোনো মালদার বাঁচামারি গ্রামে, ইংরেজবাজারের বাবলাবোনা, ঘোড়াপির, হবিবপুর, গাজোল, বামনগোলা, সানাদিঘিতে চৈত্র মাসে বেরিয়ে পড়ে গাজনের দল। এই দলের নগেন্দ্রনাথ হালদার, খোকা বিশ্বাস, সজেন মণ্ডল, জগন্নাথ হালদারদের কেউ কৃষিজীবী, কেউ মাছ ধরে বা জাল বুনে সংসার চালান। ওঁদের গাওয়া গানে ধরা পড়ে শিব-পার্বতী, কালী-দুর্গার কথা। থাকে নিজের বা পরিবারের মঙ্গল কামনার কথাও।
গৌড় মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপিকা ও লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ ড. সুস্মিতা সোম বলেন, “দলের সংখ্যা আগের চেয়ে কিছুটা বাড়লেও উৎকর্ষ কিন্তু সে ভাবে বাড়ছে না।” হবিবপুরের গাজনের দলের জিতেন মণ্ডল, ভোলা সরকারদের আক্ষেপ, “গম্ভীরার দল দেশ-বিদেশে আমন্ত্রণ পেলেও গাজনের দলের কপালে সেই সম্মান জোটে না। তাই নতুন গানও লেখা হয় না।”
গাজনের দল হোক, শিবকালী খেলা হোক বা গমীরার দলই হোককারও আর শুধু চাষ করে সংসার চলে না। তাঁদের কয়েক জন জানালেন, “আগে চাষাবাদ করে চলত। কিন্তু এখন আর তাতে কুলোয় না। তাই অন্য রুজির খোঁজে চেষ্টা চালাতে হয়। কাজের খোঁজে কেরল, কর্নাটক, দিল্লি বা রাজস্থানে যেতে হচ্ছে।” দীনেশ রায় বলেন, “উপযুক্ত প্রচার পেলে এই লোকায়ত সংস্কৃতিকে এখনও বাঁচানো সম্ভব। প্রচার পেলে শিল্পীদের মধ্যে চর্চা হবে। তাঁদের হারানো আগ্রহও ফিরে পাওয়া যাবে।”

নতুন রেকর্ড
পণ্ডিত রবি শঙ্করের বাজানো শেষ রেকর্ডটি মুক্তি পেতে চলেছে আগামী মে মাসে। একটি মার্কিন সংবাদ সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে মোট সাতটি রেকর্ড বাজারে আসবে। ২০১১ সালে ৯১ বছরের রবিশঙ্কর তবলাবাদক তন্ময় বসুর সঙ্গে এই রেকর্ডগুলি করেছেন। তার মধ্যে ২০১২ সালে চারটি রেকর্ড মুক্তি পেয়েছে। আরও তিনটি রেকর্ড মে মাসে মুক্তি পাবে।


দিল্লিতে এক ফ্যাশন শো-এ অভিনেত্রী সোনম কপূর। ছবি: পিটিআই



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.