এক বারও সরাসরি নাম নিলেন না। তবু কলকাতা সফরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য নরেন্দ্র মোদীর বার্তা পড়ে নিতে অসুবিধে হল না!
প্রথমত, পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের শাসনে এত ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে যে মেরামত করতে নতুন সরকারের অনেক সময় প্রাপ্য বলে মনে করছেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি আশাবাদী, এ রাজ্যের মানুষের স্বপ্নপূরণ করতে পারবে বর্তমান সরকার।
দ্বিতীয়ত, ইউপিএ বহির্ভূত দলগুলি ক্ষমতায় আছে, এমন রাজ্যগুলির সঙ্গে কেন্দ্রের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের আচরণ বৈষম্যমূলক। ভারতের সংবিধান ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সঙ্গে এই আচরণ একেবারেই মানানসই নয়। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গেও দিল্লির এই আচরণ পীড়াদায়ক। মধ্য কলকাতার পাঁচতারা হোটেলে বণিকসভার আসরে, স্পষ্ট কথা গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর।
প্রথম বার্তাটি সরাসরি তৃণমূল নেত্রীর প্রতি সহমর্মিতামূলক। দীর্ঘ ৩৪ বছরের ‘অপশাসনে’র বোঝা ঠেলে রাজ্যের জন্য কাজ করতে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন বলে যে দাবি মমতা অহরহ করেন, মঙ্গলবার তারই প্রতিধ্বনি করলেন আর এক ‘ম’! আবার তাঁর দ্বিতীয় বার্তাতেও বলা আছে সেই কথাই, দিল্লির ইউপিএ সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েনের আবহে ইদানীং যা নিয়মিতই বলেন এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। |
‘গুরুজি’র কাছে। বেলুড় মঠে স্বামী আত্মস্থানন্দের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী। ছবি: রণজিৎ নন্দী। |
এই দুই বার্তার সমন্বয় ঘটিয়ে বিজেপি সূত্র বলছে, ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী-পদপ্রার্থী হিসাবে এ বারের কলকাতা সফরে কৌশলী রাজনীতিই করে গেলেন মোদী। মমতার সরকারের প্রতি কোনও বিরূপ মন্তব্য না-করে, বরং তাঁর লড়াইয়ের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে তৃণমূলের জন্য ভবিষ্যতের দরজা খুলে রেখে গেলেন।
মমতার প্রতি মোদীর এই বার্তাকে কেন্দ্র করে সিপিএম তাই বলতে শুরু করেছে, তৃণমূল এবং বিজেপি-র তলায় তলায় বোঝাপড়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে গেল। বস্তুত বণিকসভার পরে এ দিন বিকেলে মহাজাতি সদনে বিজেপি-র দলীয় সভাতেও মমতা সম্পর্কে কোনও মন্তব্যের পথে যাননি মোদী। গোটা ঘটনায় প্রদেশ কংগ্রেসও ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’ বলে মনে করছে। আর তৃণমূল দিনের শেষে মোদীর অবস্থানকে ‘বাস্তববাদী’ বলে বর্ণনা করতে চাইছে।
স্বয়ং তৃণমূল নেত্রী যেমন এ দিন প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, “এক জন মুখ্যমন্ত্রী অন্য রাজ্যের প্রশংসা করতেই পারেন। এর মধ্যে রাজনীতি খোঁজা উচিত নয়।” দলনেত্রীর সুরেই তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “বাস্তববাদী কোনও নেতা এ রাজ্যের পরিস্থিতি দেখে যা বলবেন, মোদী তা-ই বলেছেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে যা বলেছেন, তাতেই বোঝা যাচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে উন্নয়ন প্রক্রিয়া তাঁর চোখে পড়েছে। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে ৩৪ বছরের গর্ত বোজানোর চেষ্টা হচ্ছে বলেছেন। অন্যায় তো কিছু বলেননি!” শিল্পমন্ত্রীর আরও দাবি, শিল্পক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ কিছুটা হলেও প্রতিযোগিতার জায়গায় আসতে পেরেছে বলেই কলকাতায় বণিকসভার আসরে এসেছেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী।
তৃণমূল নেতৃত্ব বিলক্ষণ জানেন, পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু ভোটের কথা মাথায় রেখে তাঁদের পক্ষে সরাসরি বিজেপি এবং বিশেষত, মোদীর হাত ধরা অস্বস্তিকর। সেই জন্যই মোদীর শংসাপত্রকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ‘বাস্তববাদী’ এক মুখ্যমন্ত্রীর মূল্যায়ন হিসাবে দেখছেন তাঁরা। বিজেপি সূত্রের খবর, চতুর্থ বার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়ার সময় মোদী চেয়েছিলেন মমতা গাঁধীনগরে উপস্থিত থাকুন। সেই মর্মে বার্তাও পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কোন রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় মমতার পক্ষে এই ধরনের অনুষ্ঠানে হাজির থাকা সম্ভব নয়, তা বুঝতেও ভুল করেননি মোদী। এবং তার জন্য তৃণমূল নেত্রীর প্রতি কোনও বিরূপ মনোভাবও পুষে রাখেননি। বরং কলকাতা সফরে সুযোগ পেয়েই তৃণমূলের জন্য সদর্থক বার্তা রেখে গিয়েছেন। আবার তৃণমূলও উচ্চকিত উচ্ছ্বাসে না-গিয়ে এক মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি আর এক মুখ্যমন্ত্রীর বার্তার মধ্যেই গোটা বিষয়টা সীমাবদ্ধ করে দেখাতে চেয়েছে।
ভারত চেম্বার অফ কমার্স, ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স এবং এমসিসি চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এই তিন বণিকসভার যৌথ আয়োজনে তাঁর ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ মডেল নিয়ে বলতে গিয়ে এ দিন সকালে মোদী শুরুটা করেছিলেন অত্যন্ত সুকৌশলে। বণিকসভার প্রতিনিধিদের সামনে তাঁর সহাস্য মন্তব্য ছিল, “গুজরাতে কী হচ্ছে, কী হচ্ছে না এটা আপনারা শুনতে চান নিশ্চয়ই। কিন্তু মিডিয়া তা চায় না! তারা চায় মোদী একটা শব্দ বলুক আর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে তুলনা শুরু হোক! কিন্তু আমি এই কাজের জন্য আসিনি। সেটা শুধু ভোটের সময় করি! আমি যা কিছু বলছি, মনে করুন আমদাবাদে বসেই বলছি!”
এই কূটনীতির মোড়কেই মোদী এর পরে বলেছেন, “গুজরাতে কংগ্রেসের বন্ধুরা যে গর্ত করে গিয়েছেন, তার জন্য আমাদের ১০ বছর গিয়েছে। বাংলায় তো ৩২ বছর (আসলে ৩৪) ধরে গর্ত করা হয়েছে! মানুষ যাকেই দায়িত্ব দেবে, তার না জানি কত বছর লাগবে! এখন যা হচ্ছে, আশা করি গর্ত বোজানোর জন্যই হচ্ছে! বাংলার মানুষের স্বপ্ন নিশ্চয়ই পূরণ হবে।”
কেন্দ্রীয় সরকার কী ভাবে ইউপিএ বহির্ভূত দলগুলির পরিচালিত রাজ্যগুলির সঙ্গে বৈষম্য করছে, তার বিবরণ দিতে গিয়ে মোদী অভিযোগ করেছেন: ভাল কিছু হলে কৃতিত্ব নেব, খারাপ কিছু হলে রাজ্যের ঘাড়ে চাপাব এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় চলে না! মোদীর কথায়, “বাংলার সঙ্গে এটাই হচ্ছে। এটা পীড়াদায়ক। আমাদের (গুজরাত) সহ্য করার তাকত হয়তো বেশি। কিন্তু এখানে ৩২ বছরের রোগে প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়েছে!”
মোদীর এমন বক্তব্যের পরে প্রত্যাশিত ভাবেই মুখ খুলেছে সিপিএম। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “আমাদের কোথায় কী খাদ (গর্ত) রয়েছে, উনি বলেছেন। কিন্তু নিজের রাজ্যে গোধরা-কাণ্ডের পরে যে খাদ উনি তৈরি করেছেন, সারা দেশেই কেউ তা পূরণ করতে পারবে না!” তৃণমূল-বিজেপি’র পুরনো সম্পর্কের কথাও তুলেছেন সিপিএমের এই পলিটব্যুরো সদস্য। মোদীর সফরের মূল উদ্দেশ্য যে পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন নয়, বরং গুজরাতের জন্য বিনিয়োগ জোগাড় এ দিন সেই খোঁচাও দিয়েছেন সূর্যবাবু।
কংগ্রেস মনে করছে, মোদীর প্রশংসার নেপথ্যে মমতার সঙ্গে ‘রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে’র ইঙ্গিতই রয়েছে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের কথায়, “স্থানীয় বিজেপি যা বলছে, মোদীর মুখে তা শোনা গেল না কেন? তা হলে কি স্থানীয় বিজেপি-কে বাদ দিয়ে কেন্দ্রীয় বিজেপি নতুন করে মমতাকে নিয়ে পরিকল্পনা করছে? এনডিএ জমানায় যা হয়েছিল, তারই পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলছে কি?” এ সবের প্রেক্ষিতেই ‘ডাল মে কুছ কালা’র কথা বলেছেন প্রদীপবাবুরা।
এক সময় মোদীকে ‘গুড এম’ আর মমতাকে ‘ব্যাড এম’ বলে বর্ণনা করেছিলেন রতন টাটা। এ দিন কিন্তু স্বল্প সময়ের মধ্যেই নরেন্দ্র দামোদারদাস মোদী বুঝিয়ে গেলেন, দূরত্ব নয়, মমতাকে কাছেই টানতে চান তিনি। |