মার্গারেট থ্যাচারের সহিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মিল অনেক। উভয়েই রাজনীতিতে স্বয়মাগতা। প্রথম জন তাঁহার দেশের, এবং দ্বিতীয় জন তাঁহার রাজ্যের প্রথম মহিলা প্রধান। লিঙ্কনশায়ারের এক মুদির কন্যার সহিত কলিকাতার হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের একটি মেয়ের মিল আপাত ভাবে যত, গভীর বিশ্লেষণে তাহার অধিক। মার্গারেট থ্যাচারের উত্থান অদৃষ্টপূর্ব, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। ব্রিটেনের রাজনৈতিক সমাজ যতখানি পুরুষশাসিত, উচ্চবর্ণীয় পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সমাজ, তাহার যাবতীয় বামপন্থী গর্বসমেত, তাহার এক চুলও কম নহে। দুর্বলতর লিঙ্গের এক অজ্ঞাতকুলশীল রাজনীতিক সেই পুরুষতন্ত্রের দুর্গ অধিকার করিয়া লইতেছেন— ১৯৭৯ সালের ব্রিটেন এবং ২০১১ সালের পশ্চিমবঙ্গে ঘটনাটি একই রকম ব্যতিক্রমী। আরও একটি মিল উভয়েই বিশ্বাসের রাজনীতিতে আস্থাবান। মার্গারেট থ্যাচার বাজারে বিশ্বাস করিতেন। তিনি শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সেই বিশ্বাসে অবিচলিত ছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নিজের বিশ্বাসে অনড়। তিনি ইমামদের ভাতার ব্যবস্থা করিয়াছেন, শিল্পমহলের শত অনুরোধ-উপরোধেও জমি অধিগ্রহণের নাম করেন নাই। কেহ বলিতে পারেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির কেন্দ্রে যে বিশ্বাস, তাহা ভোটব্যাঙ্কের মন জয়ের উদ্দেশ্যেই গড়িয়া উঠিয়াছে। যে বিশ্বাসের কথা বলিলে মা-মাটি-মানুষের মন পাওয়া যায়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সেই বিশ্বাসেই স্থিত হইয়াছেন। তবে, সেই কূট তর্ক আপাতত থাকুক।
মানুষ যেমনটি চাহিয়াছে, উভয় নেত্রীই তেমন ইহাই তাঁহাদের মধ্যে সর্ববৃহৎ মিল। তবে মার্গারেট থ্যাচার আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে এমন লন্ডন-কলিকাতা ফারাক কেন হইল? কেন প্রথম জন এক হৃতগৌরব দ্বীপরাষ্ট্রকে জগৎসভায় তাহার সম্মান ফিরাইয়া দিতে সক্ষম হইলেন আর দ্বিতীয় জন এই মৃতপ্রায় রাজ্যটির মৃত্যু সুনিশ্চিত করিতে উদ্যত? এই প্রশ্নের উত্তর আছে তাঁহাদের সমাজের মানসিকতার মধ্যে। ১৯৭৯ সালের ব্রিটেনে হতাশা ছিল সর্বব্যাপী ভ্রান্ত সমাজতন্ত্রের শিকার হইয়া দেশটি কার্যত পঙ্গু হইয়া পড়িয়াছিল। ধনতন্ত্রের অকুণ্ঠ সমর্থক থ্যাচার ছিলেন পরিবর্তনের হাওয়া। ২০১১ সালের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন। কিন্তু ক্ষমতা অর্জনোত্তর ইতিহাস বিপ্রতীপ। থ্যাচার অবিচল চিত্তে সংস্কারের পথে হাঁটিয়াছেন। রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে লাগাম টানিয়াছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ করিয়াছেন, সর্বোপরি জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন বিনাশ করিয়াছেন। হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের কন্যা ক্ষমতায় আসিয়া ক্লাবে-ক্লাবে সরকারি টাকা বিলি করিয়াছেন, আত্মঘাতী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে সমর্থন জোগাইয়াছেন, বিনিয়োগ আসিবার জানালাগুলি সজোর বন্ধ করিয়াছেন। থ্যাচারের সংস্কার তাঁহার সমাজের সমর্থন পাইয়াছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতিও তাঁহার সমাজের অনুমোদন পাইতেছে। সমাজের অনুমোদন ভিন্ন নেতা স্থায়িত্ব পান না। সমাজ যাঁহাকে অনুমোদন করে, সমাজ সেই নেতাই পায়।
পশ্চিমবঙ্গের সমাজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাইয়াছে। সেই বঙ্গসমাজ, একদা যাহা নাকি ভারতের পথপ্রদর্শক ছিল। সেই পণ্ডিতম্মন্য বঙ্গসমাজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতিকেই গ্রহণ করিয়াছে। যে রাজনীতির কোনও সদর্থক অভিমুখ নাই, যে রাজনীতি অর্থনীতি হইতে বিযুক্ত, সেই রাজনীতিই পশ্চিমবঙ্গের সমাজে মান্য হইয়াছে। বাঙালি চণ্ডীমণ্ডপের বাহিরে ভাবিতে শিখে নাই। কোন্দলেই তাহার আনন্দ। মমতা সেই আনন্দের হাট মেলিয়া দিয়াছেন। দোষারোপের রাজনীতিতেই বাঙালি সুখী হইয়াছে। প্রশ্ন করে নাই, রাজ্যে বিনিয়োগ না আসিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম চাকুরির সন্ধানে কোথায় যাইবে? জানিতে চাহে নাই, গায়ের জোরে বিদেশি পুঁজিকে আটকাইবার পর চাষিদের স্বার্থরক্ষায় নেত্রী ঠিক কী করিলেন? বলে নাই, ইমামদের তোষণ করিলে সংখ্যালঘুর উন্নয়ন হয় না। বেপরোয়া ছাত্রদের সংযত করিবার দাবি জানায় নাই, রাজনৈতিক গুন্ডারাজ মানিয়া লইয়াছে। মৃতজীবী উদ্ভিদ যেমন পচন ভালবাসে, বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণিও তেমনই সমাজের প্রতিটি পচনে আপন ক্ষুদ্র স্বার্থের ঠিকানা খুঁজিয়া লইয়াছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহাদের আরাধ্যা। কেন কলিকাতা কখনও লন্ডন হইবে না, তাহা বুঝিতে আর সমস্যা কী? |