ঘোষিত কর্মসূচি ছিল গুজরাতের মডেলের সাফল্য বর্ণনা। সেই সুযোগকেই দু’হাতে ব্যবহার করে বৃহত্তর ভারতের লক্ষ্যে অভিযান চালিয়ে গেলেন নরেন্দ্র মোদী!
মঞ্চ ছিল বণিক সভার। শ্রোতারাও শিল্প ও বাণিজ্য জগতের সঙ্গে জড়িত। মোদী মুখে দাবি করলেন, তিনি ‘রাজনীতিক’ হিসাবে এখানে আসেননি। কিন্তু কাজে করলেন ঠিক উল্টো! বণিক সভার মঞ্চকে ব্যবহার করলেন রাজনৈতিক কায়দায় এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে! স্পষ্ট বাক্যে, কথার ফাঁকে ফাঁকে রসিকতা গুঁজে বোঝাতে চাইলেন বহু সীমাবদ্ধতা নিয়েও গুজরাতকে তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় আনতে পেরেছেন। অথচ অনেক বেশি সুযোগ নিয়েও কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার পক্ষপাতগ্রস্ত হয়ে রয়েছে!
গুজরাত এবং দিল্লির তুলনামূলক আলোচনা থেকে মোদীর অন্তর্নিহিত আবেদনও স্পষ্ট যে ব্যক্তি গুজরাতকে এত প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে উন্নয়নের মডেল হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন, দিল্লির তখতে তাঁকে এ বার সুযোগ দিতে ক্ষতি কী? |
মধ্য কলকাতার পাঁচ তারায় তিন বণিক সভার যৌথ মঞ্চ থেকে মোদী মঙ্গলবার প্রশ্ন তুলেছেন, “ইউপিএ সরকার কী ভাবে চলছে? ফাইল পড়ে আছে দু’বছর ধরে! সরকার খালি ভাবছে, গোপন ক্যামেরায় কিছু ধরা পড়ে গিয়ে পাছে সিবিআই বা অন্য কেউ তদন্ত করতে চলে আসে! সব কাজ আটকে আছে। অথচ এদের কোনও চিন্তা নেই!” এরই সঙ্গে মোদী-সুলভ রসিকতা, “ঘরে কোনও অসুস্থ লোক থাকলে দেখবেন, বার বার সময় জানতে চায়। তার কোথাও যাওয়ার নেই। কিন্তু কেউ ঘরে ঢুকলেই সময় জানা চাই। দিল্লির সরকারও সে রকম। ক্যালেন্ডারে এরা ২০১৪ সাল পর্যন্ত আছে। কিন্তু এখন ক্যালেন্ডার নয়, বার বার ঘড়ি দেখছে!”
শিল্প ও বণিক মহলকে তা-ই বলে শিল্পের কোনও কথা বলেননি মোদী, এমন নয়। তবে সেটা নির্দিষ্ট করে শিল্প নিয়ে নয়। বলেছেন, প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে গুজরাতে কী ভাবে সামগ্রিক উন্নয়ন হয়েছে। আবার এরই মধ্যে মওকা পেয়ে গুজরাতে পর্যটন শিল্পে উন্নতির লক্ষ্যে সওদাগরের ভূমিকা পালন করতে ছাড়েননি! বলেছেন, “দেখেন তো, অমিতাভ বচ্চন টিভি-তে বলছেন কয়েকটা দিন গুজরাতে কাটিয়ে যান। আসুন না! কয়েক দিন গুজরাতে কাটিয়ে যান! তা হলে রাজ্যের পর্যটনের ভাল হয়।”
গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বর্ণনা দিয়েছেন, তীব্র জলাভাব এবং বিদ্যুৎ সঙ্কটের এক রাজ্যে কী ভাবে প্রত্যন্ত গ্রামেও পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া গিয়েছে। বুঝিয়েছেন, তাঁর উন্নয়নের মডেলে তিন ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হয়েছে কৃষি, উৎপাদন এবং পরিষেবা। মোদীর কথায়, “আমাদের উন্নয়নের এই তিনটি স্তম্ভ। প্রত্যেকটিরই এক-তৃতীয়াংশ করে গুরুত্ব।” তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, বণিক সভার আসর হলেও শিল্পোন্নত গুজরাতে কৃষির গুরুত্ব বোঝাতে চেষ্টার কসুর করেননি মোদী। বলেছেন, তাঁর রাজ্যেই একমাত্র কৃষকের হাতে মাটির হেল্থ কার্ড আছে। জমিতে কোন সার কতটা দিতে হবে, সম্যক জানা থাকে কৃষকের। এবং এই বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গেই কেন্দ্রের উদ্দেশে মোদীর পরামর্শ, “কবে বৃষ্টি হবে আর কৃষক পরিশ্রম করে ফসল ফলাবে, এই ভরসায় বসে থাকলে সরকারের চলে না! কৃষি উৎপাদন চালাতে সরকারের হস্তক্ষেপ আবশ্যক।”
শুধু কৃষিতেই শেষ নয়। গোটা দেশে আর্থিক বৃদ্ধির হার যে ভাবে ভেঙে পড়ছে, তাতে আক্ষেপ করেছেন মোদী। দেখাতে চেয়েছেন গুজরাতের বিপরীত চিত্র। বণিকের আসরে কৃষির গল্প এবং নিজের রাজ্যের সঙ্গে বাকি দেশের বৃদ্ধির হারের তুলনা এতেই স্পষ্ট, শিল্প-আলোচনা নেহাতই উপলক্ষ ছিল মোদীর কাছে। তিনি আসলে গুজরাতের চশমা দিয়ে গোটা ভারতের স্বপ্ন দেখছেন! বণিক সভা থেকেই প্রশ্ন ছিল, গুজরাতের মডেল কি অন্য রাজ্যে কাজে লাগবে? মোদীর জবাব, “এক জেলার মডেল পাশের জেলাতেও হুবহু কাজে লাগানো সম্ভব নয়। তবে মূল দর্শন এবং কৌশল কাজে লাগানো যেতে পারে। বাকিটা রদবদল (মোডিফিকেশন) করে নিতে হয়। মোদী-ফিকেশন লাগে না!”
একেবারে শেষে সরাসরি প্রশ্ন ছিল, প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে কিছু বলবেন? এ বার মোদীর জবাব, “আমি রাজনীতিক নই। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে তো এখানে আসিনি!” মুখে অ-রাজনৈতিক। কাজে পুরোদস্তুর রাজনৈতিক। হোটেলের বাইরে এবং শহরের অন্যত্র কিছু বামপন্থী সংগঠনের বিক্ষোভের মধ্যেই নিজের আসরে নিজের কাজ সেরে গেলেন মোদী। |