আইপিএল সত্যি বড় নিষ্ঠুর। কে যে কখন এখানে বাদশা থেকে ফকির বা ঠিক উল্টোটা হয়ে যাবে, কেউ জানে না। মহানায়কেরও এখানে মুহূর্তে ঠিকানা হতে পারে ‘কেয়ার অব ফুটপাথ’। আবার নেহাতই অজ্ঞাতকুলশীল কেউ রাতারাতি চলে আসবে ঝাড়বাতির রোশনাইয়ে। মরু-শহরে রাহুল দ্রাবিড়ের নাইট-নিধন যজ্ঞ দেখলে এই চিরন্তন শিক্ষাটা মনে পড়বেই।
কে কত দাপুটে টিম, কে কবে চ্যাম্পিয়ন হয়ে কলার তুলেছিল, সেটা বড় নয়। বড় হচ্ছে, নির্দিষ্ট দিনের সাড়ে তিন ঘণ্টায়, দু’শো চল্লিশ বলের দুনিয়ায় কে কী করল। অবস্থা, পরিস্থিতি না বুঝে ‘দাদাগিরি’ দেখাতে গেলে, আইপিএলের পৃথিবীতে কপালে দুঃখ থাকে। নাইটদের সোমবার যা হল।
রাজপুতদের ১৪৪ তাড়া করতে নেমে আইপিএল ফাইভ চ্যাম্পিয়নরা ধ্বংস ১২৫-এ! ভাবা যায়? |
আজ জয়পুরে কিং খান ছিলেন না। শাহরুখ ভ্যাঙ্কুভারে। তাই আসতে পারেননি। ভাগ্য ভাল, আসেননি। জয়পুরে কী দেখতেন নাইট মালিক? মরু-শহরের ‘ধড়কন’ শিল্পা শেঠির মাঝরাত্তিরের নাচ? ডিজে-র পাগলের মতো ‘হাল্লা বোল’-এর মূর্ছনা সৃষ্টি? মাত্র ৪৩ রানের মধ্যে কেকেআর ব্যাটিংয়ের ‘ফ্যাব ফোর’-এর বিদায়? বিসলা-কালিস-গম্ভীর-মনোজ, নাইট- ব্যাটিংয়ের ‘দুর্ধর্ষ চার’ এঁরাই নিশ্চয়। দু’জনকে তুললেন সিদ্ধার্থ ত্রিবেদী। দু’টো রাহুল শুক্ল-র। প্রথম জনের নাম যদি একটু-আধটু শুনেও থাকেন, দ্বিতীয় জনকে শত ভেবেচিন্তেও কেউ মনে করতে পারবেন না। পরিচিত মুখ কেউ নন, তাই শুনেই চেনার কথা নয়। তবে অপরিচিত হলেও এঁদের অন্য একটা পরিচয় আছে। এঁরা দ্রাবিড়-সভ্যতার ‘প্রোডাক্ট’। কেকেআর ব্যাটিংয়ের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি যাঁরা ঘটিয়ে ফেললেন পাঁচ উইকেট নিয়ে!
এবং মগজাস্ত্রের যুদ্ধটাও তো রাহুল দ্রাবিড় জিতে গেলেন। অনেক বেশি ‘হেভিওয়েট’ টিম নিয়েও গৌতম গম্ভীর রাতের জয়পুরে শাসিত। পুরস্কার-বিতরণী অনুষ্ঠানে যখন হেঁটে আসছিলেন নাইট অধিনায়ক, মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। স্বাভাবিক। কেউ ভেবেছে, ভারতের মাঠে কোনও অধিনায়ক পাঁচ পেসার নিয়ে নেমে পড়বে? টিমে একটাও স্পিনার থাকবে না? ‘অর্ডার’ দেবে এমন এক ‘গ্রিন টপ’-এর, যেখানে নামী-অনামী পেসারের পেস স্পিডোমিটারে ১৪০ ছুঁয়ে যাবে, যা দেখে টুইট উড়বে, ‘ধোনি, দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়ার আগে একবার জয়পুরে কয়েকটা ম্যাচ খেলো। কেপটাউনের কাছাকাছি উইকেট কিন্তু!’ |
কেউ না ভাবলেও রাহুল দ্রাবিড় ভেবেছিলেন। পাঁচ পেসার খেলানোর উদ্ভাবনী শক্তির জন্য আলাদা একটা পুরস্কারও পেলেন। স্বভাবসিদ্ধ লাজুক কর্নাটকী মুখে বলছিলেন, “আমি আর কী করেছি? যা করার করল আমার বোলাররা। ব্যাটসম্যানরা।” মুখে যা-ই বলুন, এসএমএস স্টেডিয়ামের মালিও জানে রাহুল কী বস্তু। জানে, সিদ্ধার্থ-রাহুলরা নিছকই ‘যন্ত্র’। যন্ত্রী ওই চল্লিশ ছুঁইছুঁই নিপাট ভদ্রলোক। প্রতিভা খুঁজতে গোটা দেশ যিনি চষে ফেলেছেন। ফ্র্যাঞ্চাইজির কর্কশ দুনিয়ায় ক’জন ভাবেন এমন? ক’জন এমন আদা-জল খেয়ে নেমে পড়েন নিজের ক্রিকেট-শিক্ষা পরবর্তী প্রজন্মের অবচেতনে ঢুকিয়ে দিতে? দ্রাবিড় পারবেন না তো কে পারবে?
গৌতম গম্ভীরও জানেন, যোগ্য লোকের কাছে হেরেছেন। তাই বলেও গেলেন, “উইকেটকে দোষ দেব না। খুব ভাল উইকেট। আমরাই পারিনি। একটাও পার্টনারশিপ হল না!” ভাবলে এক দিক থেকে ঠিক। উইকেট সবুজ ছিল, কিন্তু এখানেও ব্যাটিং করা যায়। তার জন্য দরকার ধৈর্য, পরিস্থিতি বুঝে খেলার মানসিকতা। যা ইয়ন মর্গ্যানের আছে। প্রাক্তন নাইট ব্র্যাড হজ দেখিয়ে গেলেন। অথচ দেখানোর যাঁদের কথআ ছিল, অর্থাৎ কালিস-মনোজ-ইউসুফরা কেউ বুঝতেই পারলেন না, আইপিএলটা বিনোদনে টইটম্বুর হলেও আদতে ব্যাপারটা ক্রিকেট। |
স্টেপ আউট করতে গিয়ে গম্ভীর কট বিহাইন্ড। অচেনা খোঁচায় কালিস-বিদায়। মনোজ হেঁটে-হেঁটে ওটা ঠিক কী করতে চাইলেন, বোঝা গেল না। ইউসুফ পাঠান যা ছিলেন, তাই আছেন। এসএমএস স্টেডিয়ামে বড় মাঠে টার্গেটটা সম্ভ্রমজনক হলেও ছোঁয়া অসম্ভব ছিল না। নারিনরা খুব খারাপ করেননি। গ্রিন টপে সাতের উপর রান দিয়েও ক্যারিবিয়ান ‘মিষ্ট্রি স্পিনারের’ পকেটে দু’টো উইকেটে। ব্রেট লি-ও একশোয় একশো। লক্ষ্মীরতনের প্রথম বলে উইকেট। মন্দ কী? রোজ-রোজ তো বিপক্ষকে একশো কুড়িতে শেষ করা সম্ভব নয়। শুধু প্রয়োজন ছিল আর একটু পরিণত ব্যাটিং-বোধের। তবে একবার ৪৩-৪, বা ৬১-৬ হয়ে গেলে তাতেও আর লাভ হয় না। মর্গ্যানের একক যুদ্ধ তাই শুষ্ক পিঠ চাপড়ানিটুকুই পাবে। তার চেয়ে বেশি মর্যাদা নয়। |
কেকেআরের তা হলে ভবিষ্যৎ? বৃহস্পতিবার বেঙ্গালুরু ম্যাচ। সামনে শান্ত দ্রাবিড় নন। উন্মত্ত ক্রিস গেইল। যে কোনও টিমকেই থেঁতলানি দেওয়াটা যাঁর নিয়ম, পুরনো টিমকে দেখলে তো আরওই। জয়পুর যত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়া যায়, ততই ভাল। পাঁচে হার চার বার। প্রেসবক্সে কে আবার যেন মাঝরাতে বলে উঠলেন, “গত বারও ম্যাচটা এখানে ৮ এপ্রিল-ই ছিল! তফাত শুধু রানে। বাইশের বদলে উনিশ!” |
|
গতির আগুন |
|
শন টেট (দ্রুততম বল ১৫০ কিমি) ৪ ওভারে ১-২৯
রাহুল শুক্ল (দ্রুততম বল ১৪০ কিমি) ৩ ওভারে ২-২৮
শ্রীসন্থ (দ্রুততম বল ১৩৫ কিমি) ৪ ওভারে ১-২৫
কেভন কুপার (দ্রুততম বল ১৩০ কিমি) ৪ ওভারে ৩-১৫
সিদ্ধার্থ ত্রিবেদী (দ্রুততম বল ১৩০ কিমি) ৪ ওভারে ৩-২৩ |
বিস্তারিত স্কোর... |
|
গম্ভীর ও শিল্পার ছবি তুলেছেন উৎপল সরকার। |