কাজিরাঙ্গার ছায়া পড়েছে বক্সায়।
গত দু’মাসে উত্তরবঙ্গের পরিচিত ওই ব্যাঘ্র প্রকল্পে চোরাশিকারিদের গুলিতে মারা গিয়েছে পাঁচটি হাতি। সেই তালিকায় শেষ সংযোজন, রবিবার পূর্ব রায়ডাক রেঞ্জে পূর্ণ বয়স্ক একটি পুরুষ হাতি। দাঁত তো বটেই, চোরাশিকারিদের ধারাল করাতে উপড়ে নেওয়া হয়েছে তার পায়ের নখ, অন্ত্রের কিছুটা অংশও। হাতিটির শরীরে মিলেছে বিষ মেশানো সিসার গুলিও।
সোমবার রাতে কুমারগ্রামের খোয়াডাঙা থেকে চোরাশিকারি সন্দেহে দু-জনকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। পুলিশ জানায়, আঞ্জুলুস বহুমাতা এবং নিরঞ্জন বহুমাতা নামে ওই দু’জনই প্রাক্তন বড়ো জঙ্গি।
এই অবস্থায় বন-বাঁচাতে চোরাশিকারিদের মোকাবিলায় ‘ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম ব্যুরো’ তৈরির প্রস্তাব দিয়েছেন বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের ফিল্ড ডিরেক্টর রবীন্দ্রপাল সাইনি। তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, বনকর্মীর অভাব না মেটানো হলে জঙ্গলে নজরদারি বাড়ানো সম্ভব নয়। ফলে, বক্সার জঙ্গলে কাজিরাঙ্গার ‘ভূত’ দেখতে শুরু করেছেন পশুপ্রেমীরা।
দেশের শ্রেষ্ঠ জীব বৈচিত্র্যের পীঠস্থান, অসমের কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যান বছরখানেক ধরে কার্যত চোরাশিকারিদের মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছে। মাত্র দু’মাসের ব্যবধানে পাঁচটি হাতির মৃত্যুতে বক্সাও সে পথেই হাঁটছে বলে বন কর্তাদের অনেকেই সে আশঙ্কা আড়াল করছেন না। ক্রমান্বয়ে হাতি-মৃত্যুতে কপালে ভাঁজ পড়েছে বনমন্ত্রী হিতেন বর্মনেরও। তিনি বলেন, “দ্রুত কিছু একটা ব্যবস্থা নিতেই হবে।” কিন্তু কী সেই ব্যবস্থা?
গত কয়েক বছর ধরেই কর্মী-অভাবে ভুগছে রাজ্যের বন দফতর। তার উপর সরকার বদলের পরে নব্য ট্রেজারি আইনের ফাঁদে পড়ে বন দফতর নতুন করে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগও বন্ধ করে দিয়েছে। উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ জঙ্গলেই তাই বেড়ে গিয়েছে চোরাশিকারিদের আনাগোনা।
বন দফতর সূত্রে খবর, গত কয়েক বছর ধরে বন সুরক্ষার দায়ভার ১৩০ টাকা রোজে সামাল দিতেন অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োজিত এই কর্মীরা। কিন্তু ট্রেজারি বিধির ফলে তাঁদের সামান্য ভাতা পেতে বছর ঘুরে যাচ্ছে। টাকা না পেয়ে তাঁরা আর বন সুরক্ষার কাজ করতে চাইছেন না। পদস্থ এক বনকর্তা বলেন, “ট্রেজারি বিধি একই সঙ্গে ওই মানুষগুলোর ভাতের থালায় টান মারছে। সেই সঙ্গে থমকে গিয়েছে বন প্রহরাও।”
বছর কুড়ি আগে, ১৯৯৩ সাল নাগাদ একই ভাবে চোরাশিকারিদের দৌরাত্ম্য শুরু হয়েছিল বক্সায়। ক্রমান্বয়ে মারা পড়ছিল হাতি। এ বারও সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি শুরু হওয়ায় শনিবার বক্সায় ছুটে গিয়েছেন প্রধান মুখ্য বনপাল (ওয়াইল্ড লাইফ) নবীনচন্দ্র বহুগুণা। তিনি বলেন, “পর পর এ ভাবে হাতি-মৃত্যু কাম্য নয়। সুরক্ষার কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা নিয়ে কালই শিলিগুড়িতে বৈঠকে বসা হবে।”
তবে, রবীন্দ্রপাল বলেন, “৭৬১ বর্গ কিলোমিটার ব্যাঘ্র প্রকল্প কি সাকুল্যে দুশো জন কর্মী দিয়ে পাহারা দেওয়া যায়! প্রহরার অভাবে জঙ্গলের সুরক্ষাই ভেঙে পড়েছে।”
উত্তরবঙ্গের পরিবেশপ্রেমী সংগঠন ন্যাফের মুখপাত্র অনিমেষ বসুও বলেন, “কর্মী-ঘাটতি যে অবস্থায় দাঁড়িয়েছে তাতে জঙ্গল ক্রমেই চোরাকারবারিদের মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠছে।” হস্তি বিশারদ পার্বতী বড়ুয়ার মন্তব্য: “দ্রুত নজরদারি বাড়ানোর ব্যবস্থা না হলে হস্তিকুল বাঁচবে কী করে!”
ব্যাঘ্র প্রকল্প সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে পাঁচটি হাতিকেই বিষ মাখানো গুলি করে মারা হয়েছে। চোরাশিকারিরা অসমের কোকরাঝাড় সংলগ্ন এলাকা থেকে বক্সায় অনুপ্রবেশ করছে বলেই বনকর্তাদের অনুমান। বনকর্মীরা জানান, শনিবার রাতে গুলির শব্দ শুনে তাঁরা তল্লাশি শুরু করেছিলেন। রবিবার হাতিটির দেহ মেলে। |