বদল নেই বস্তারে
হত্যালীলার ৩ বছর পর একবেলার এইমস সেবা
ত্তীসগঢ়ের কার্গিলে আপনি স্বাগত!
দোরনাপাল চৌপথি হয়ে ডান দিকে চিন্তলনারের রাস্তায় গাড়ি ঘোরা মাত্রই অপেক্ষারত পথপ্রর্দশক যুবক হাত বাড়িয়ে দিলেন। যদিও কার্গিলের উপমায় একটু ভুল রয়েছে। ওখানে লড়াইটা ছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে। এখানে এই দক্ষিণ বস্তারে যা চলছে, তা পুরোদস্তুর গৃহযুদ্ধ! সে কথা পরে।
এই পথেই এসেছিলাম তিন বছর আগে। ২০১০-এর ৬ এপ্রিল এই চিন্তলনার ও টারমেটলার মাঝে মুকরানার জঙ্গলে চার দিক থেকে ঘিরে ধরে সিআরপিএফ ও ছত্তীসগঢ় রাজ্য পুলিশের ৭৬ জনকে মেরেছিল মাওবাদীরা। বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, নির্বিচার গুলি চালিয়ে, কুঠারের ঘা মেরে। তার পর জওয়ানদের অস্ত্রশস্ত্র ও গুলি-বারুদ নিয়ে নির্বিঘ্নে জঙ্গলে মিশে গিয়েছিল মাওবাদীরা। এ দেশে নিরাপত্তা রক্ষীদের উপরে সেটাই ছিল সব থেকে বড় মাওবাদী হামলা।
পরের তিন বছরে কতটা বদলেছে বস্তার? দোরনাপাল থেকে চিন্তলনার পর্যন্ত ৪৬ কিলোমিটার পথ। ফের সেই একই রকম দুর্গম যাত্রা। পথই জানান দিচ্ছে, বস্তার বদলায়নি। রাস্তা বলে কার্যত কিছু নেই। এবড়ো-খেবড়ো পাহাড়ি পথে বড় বড় পাথর। লাল মাটির ঘন ধুলো ঢেকে দিচ্ছে চার পাশ। দোরনাপাল থেকে এগোলেই জঙ্গল শুরু। সেই জঙ্গলপথে চোখে পড়তে থাকে আরও অনেক কিছুই!
দূরে ঘন জঙ্গলে ঘেরা তামেলওয়াড়া পাহাড়। চিন্তলগুফা সিআরপিএফ ক্যাম্পে পৌঁছনোর আগেই মাওবাদীদের উড়িয়ে দেওয়া সেই ভাঙা সেতু। যেতে হবে ওই পথ দিয়েই। রাস্তার পাশে ইনসাস রাইফেল উঁচিয়ে অক্সিলিয়ারি পুলিশ ফোর্সের লোকজন (আদতে সালওয়া জুড়ুম খ্যাত বা কুখ্যাত স্পেশাল পুলিশ), চিন্তলগুফা ক্যাম্পের উল্টো দিকেই কাঁকেরলঙ্কা কন্যা আশ্রমের পাকা বাড়ির ভগ্নস্তূপ। মেয়েদের ওই স্কুল যাতে নিরাপত্তা বাহিনীর স্থায়ী ডেরা না হয়ে ওঠে, তার জন্য ঝুঁকি নেয়নি মাওবাদীরা। উড়ে গিয়েছে পোলামপল্লি গ্রামের স্কুলবাড়িও। বিধ্বস্ত পড়ে রয়েছে গোরান্ডা গ্রামের হাসপাতাল ভবনও। এর মধ্যেই নজরে এল চিন্তলগুফা ক্যাম্পের বাইরে কংক্রিটের ফলক। ‘ওয়েলকাম টু হেভেন’!
রসিকতা! চারপাশে ধ্বংসের ছবি, মাথায় রোদ। এই মুহূর্তে অন্য কথা মনে এল না আর।
আর একটু এগিয়ে চিন্তলনার সিআরপিএফ ক্যাম্প। সেখানে আজ চরম ব্যস্ততা। রায়পুর থেকে হেলিকপ্টারে উড়ে এসেছেন ছত্তীসগঢ় সিআরপিএফের আইজি (অপারেশন) জুলফিকার হাসান। সঙ্গে রায়পুরের অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস-এর (এইমস) এক ঝাঁক চিকিৎসক। বিনামূল্যে এক দিনের স্বাস্থ্যশিবিরের চালানোর জন্য।
কাপড়ের অস্থায়ী ছাউনির নীচে উঠে এসেছে প্রায় গোটা চিন্তলনার গ্রাম। প্রত্যন্ত এই গ্রামে বছরভর সুচিকিৎসার আশাটাও ওই ‘ওয়েলকাম টু হেভেন’-এর মতোই...। ফলে এইমস-এর মতো প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকদের দেখানোর জন্য এই উৎসাহ স্বাভাবিকও বটে। জুলফিকার হাসান বলছিলেন, “গোটা বস্তারে সিআরপিএফের ১০০টি শিবিরের মধ্যে প্রাথমিক ভাবে ৪-৫টি ক্যাম্পে টেলি-মেডিসিন চালু করেছি। ওই সব ক্যাম্প থেকে ফোনে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন গ্রামবাসীরা।” রায়পুর এইমস-এর ডিরেক্টর চিকিৎসক নীতিন এম নাগরকরের কথায়, “আমাদের মূল লক্ষ্য প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামবাসীদের মধ্যে চিকিৎসা সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণা তৈরি করা। রোগ সম্পর্কে অহেতুক ভয় কাটানো।”
এক বেলার শিবিরে তা সম্ভব কি না সে প্রশ্ন আলাদা, কিন্তু গোটা পরিস্থিতি নিয়ে আতঙ্ক কাটাতেই কি বেছে বেছে এই দিনে স্বাস্থ্যশিবির করা? হেসে ফেলে জুলফিকার বলেন, “বলতে পারেন। তবে এটা ঘটনাচক্রে মাত্র।” এই তিন বছরে পরিস্থিতির কি আদৌ উন্নতি হয়েছে? এ বার থমথমে সিআরপিএফ কর্তার গলা, “কখন যে ভাল, আর কখন খারাপ, বলা শক্ত।”
হেলিকপ্টারের দিকে হাঁটা দেন তিনি। তাঁকে নিয়ে কপ্টার উড়তেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন গ্রামবাসীরা। বাইরে থেকে আসা একমাত্র সাংবাদিককে সামনে পেয়ে ক্ষোভ উগরে দিতে চান অনেকেই। প্রবীণা সুশীলা দেবী বলতে থাকেন, “ক্যাম্পে ডাকল। এতগুলো লোক রোদে পুড়ে এতটা পথ হেঁটে এলাম। অথচ, মাত্র কয়েক জনকে দেখে কাগজে দাওয়াই লিখে আর কাউকে ডাকল না। ওষুধও দিল না। এমন ক্যাম্প করে লাভ কী?” গলা মেলালেন মিথিলেশ রাঠৌর-সহ অনেকে। জনসংযোগের জন্যই এই মেডিক্যাল ক্যাম্প। বোঝা গেল,মাঠে মারা গিয়েছে মূল উদ্দেশ্যই! দুূর হয়নি নিরাপত্তা বাহিনী সম্পর্কে অনাস্থাও। রয়েছে কিছু স্মৃতিও!
তিন বছর আগে মুকরানার জঙ্গলের বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে রক্তের গন্ধ পেয়েছিলাম। চার দিকে ছড়ানো ক্যামোফ্লেজ উর্দির ছেঁড়া রক্তমাখা টুকরো, জুতো, রুমাল, এমনকী জওয়ানদের দেহাংশও। আজ পাতাঝরার এই মরসুমে চারদিকে মহুয়া গাছের হালকা, ঝিমধরা গন্ধ। মহুয়া ফল কুড়োচ্ছে আদিবাসীরা। তবু ভিড় করে আসে বধ্যভূমির স্মৃতিই।
যাওয়ার পথে চিন্তলগুফা ক্যাম্পের এক জওয়ান বলেছিলেন, “কী দেখতে যাচ্ছেন ওখানে? ওরা কেউ নেই।”
মাওবাদীদের মুছে ফেলা নিয়ে ওই আত্মবিশ্বাসের ভিত কতটা পোক্ত, সেটা বেরিয়ে পড়ল জওয়ানের বাকি মন্তব্যে, “আমরা আছি এখনও। তবে পরে এসে কী দেখবেন, জানি না।” মনে পড়ল, এ বছরের ১৮ জানুয়ারিই তামেলওয়াড়ায় গুলি করে বায়ুসেনার কপ্টার নামিয়েছিল মাওবাদীরা।
ওয়েলকাম টু হেভেন!

পুরানো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.