কার্টুন-কাণ্ডে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে গ্রেফতার করা নিয়ে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে রাজ্য সরকারের যে বিরোধ বেধেছিল, তার এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। এর পর পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সরকারের বিরোধ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের নিশানায় এ বার আর এক স্বশাসিত সংস্থা পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)।
সংবিধানের ৩২০ ধারা অনুযায়ী, সরকারের অধীনে কর্মরত সিভিল সার্ভিস অফিসার থেকে কেরানি পদে নিয়োগের দায়িত্ব রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষেত্রে ইউপিএসসি এবং রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে পিএসসি-র হাতে। এ রাজ্যের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু রাজ্যে পালাবদলের পরে পিএসসি-র নিয়োগ করার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সরকারের বিরুদ্ধে। পিএসসি-র কর্মচারীদের দাবি, রাজ্যে প্রায় দু’লক্ষ শূন্যপদে স্থায়ী চাকরির সুযোগ থাকলেও বর্তমান সরকারের অনীহার কারণে ওই সব পদ পূরণ করা যাচ্ছে না। পরিবর্তে পিএসসি-কে পাশ কাটিয়ে কম বেতন দিয়ে অস্থায়ী ভিত্তিতে বহু শূন্য পদে লোক নেওয়া হচ্ছে। বহু ক্ষেত্রে অবসরপ্রাপ্তদেরও পুনর্নিয়োগ করা হচ্ছে। কর্মীদের আশঙ্কা, এ ভাবে পিএসসি-কে অকেজো করে দেওয়া হলে রাজ্যে সরকারি চাকরির পরিকাঠামোই ভেঙে পড়তে পারে। তাঁদের অভিযোগ, নিয়োগের অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক রং দেখা হচ্ছে।
কী ভাবে অকেজো করা হচ্ছে পিএসসি-কে?
সূত্রের খবর, ২০০৮ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার একটি বিজ্ঞপ্তি (নং- ৯১০৩এফ, ৩ ডিসেম্বর, ২০০৮) জারি করে ঘোষণা করেছিল, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সব পদে নিয়োগের ভার পিএসসি-র হাতে থাকবে। এর ফলে আগে যে সব পদে নিয়োগের দায়িত্ব পিএসসি-র হাতে ছিল না (যেমন, ‘সি’ শ্রেণিভুক্ত কৃষি প্রযুক্তি সহায়ক, ওয়ার্ড মাস্টার প্রভৃতি), সে সব তো বটেই, এমনকী গ্রুপ ডি পদে নিয়োগের দায়িত্বও
হাতে পায় এই সংস্থা। বর্ধিত
দায়িত্ব পালন করার জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো অবশ্য সরকারের তরফে প্রদান করা হয়নি।
নতুন সরকার ২০১১-র মে মাসে ক্ষমতায় আসার পরেই পিএসসি-র অধিকার হরণের শুরু। প্রথম ধাপে রাজ্যের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দফতরের অধীনে তৈরি হয় ‘হেল্থ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড’। অথচ, বরাবরই স্বাস্থ্য দফতরের অধীন সমস্ত ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত (যেমন, সরকারি ডাক্তার (এমওজিডি), উচ্চপদস্থ মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট, ইনস্পেক্টর অফ ড্রাগস) পদে নিয়োগ হত পিএসসি-র মাধ্যমে। নতুন সরকার সেই ক্ষমতা তুলে দেয় নব গঠিত বোর্ডকে। দ্বিতীয় ধাপে, সরকারের গ্রুপ বি, সি এবং ডি পদে নিয়োগের যাবতীয় দায়িত্বও তুলে দিতে তৈরি হয় স্টাফ সিলেকশন কমিশন (এসএসসি)। এই কারণে পিএসসি-র জন্য অনুমোদিত ২৯৭টি পদ লোপের নির্দেশও দেয় নতুন সরকার। সরকারের যুক্তি ছিল, পিএসসি-র নিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রী। অতিরিক্ত কাজের ভারে পিএসসি ধুঁকছে। তাই ভার কিছুটা লাঘব করতেই এই পদক্ষেপ করা হল।
পিএসসি সূত্রে খবর, সংস্থার তৎকালীন চেয়ারম্যান সব্যসাচী সেন সরকারের কাছে চিঠি লিখে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আর্জি জানান। তাঁর বক্তব্য ছিল, গ্রুপ এ-বি-সি পদে আগের মতোই নিয়োগের ক্ষমতা থাক পিএসসি-র হাতে। শুধু গ্রুপ ডি পদে নিয়োগের দায়িত্ব নিক এসএসসি। চেয়ারম্যানের ওই প্রস্তাব প্রাথমিক ভাবে মেনেও নেয় সরকার। কিন্তু গত ১৩ মার্চ তাদের পুরনো অবস্থানে ফিরে পিএসসি-র সচিবকে চিঠি লিখে রাজ্য সরকার সাফ জানিয়ে দেয়, এখন থেকে গ্রুপ বি, সি এবং ডি পদে নিয়োগের দায়িত্ব থাকবে এসএসসি-র হাতেই।
এখানেই শেষ নয়। বাম আমলে ২০১০ সালে গ্রুপ-ডি পদে নিয়োগের জন্য একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছিল পিএসসি। তার ভিত্তিতে ২০১১ সালের শুরুতে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই করে প্রায় ২০ হাজার প্রার্থীর একটি প্যানেল তৈরি করে পিএসসি। এর মধ্যে থেকে ৩৯০৯ জনের নাম বিভিন্ন দফতরের কাছে (দফতরের চাহিদা অনুযায়ী) পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যার সিংহভাগ (২৮১৭ জন) ছিল স্বাস্থ্য দফতরে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর অধীনস্থ স্বাস্থ্য দফতর ওই কর্মপ্রার্থীকে চাকরি দিতে অস্বীকার করে। তাদের যুক্তি ছিল, পিএসসি-র সুপারিশ করা প্রার্থীরা শিক্ষিত। তাঁদের গ্রুপ ‘ডি’ পদে নিয়োগ করা যায় না। ওই প্রার্থীরা ‘স্যাট’-র দ্বারস্থ হন। গত ১৫ মার্চ রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়ে স্যাট জানিয়ে দেয়, পিএসসি-র সুপারিশ মেনে ২৮১৭ জনকে আগামী দু’মাসের মধ্যে চাকরিতে নিয়োগ করতে হবে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে মনে হলে কেন সরকারের বিরুদ্ধে আদালতের দারস্থ হচ্ছেন না পিএসসি কর্তৃপক্ষ?
এর জবাবে সংস্থার ওই কর্তা জানান, পিএসসি-র ক্ষমতা যে ভাবে সঙ্কুচিত করা হল, তাতে কর্তৃপক্ষ ক্ষুব্ধ। সংবিধান অনুযায়ী, সরকারের এই ভূমিকার বিরুদ্ধে পিএসসি-র চেয়ারম্যান আদালতের দারস্থ হতেই পারেন। তা কী তিনি হবেন?
সংস্থার সদ্য নিযুক্ত চেয়ারম্যান নুরুল হকের কথায়, “এই নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করব না।” সরকারের ভূমিকার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে সংস্থার কর্মীরা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারি কর্মচারী ইউনিয়নের যুগ্ম-সম্পাদক বিপুল রায়ের কথায়, ‘‘এর প্রতিবাদে ১০ এপ্রিল অর্থমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হবে।”
তার পরেও কাজ না হলে?
আন্দোলন করা ছাড়া অন্য কোনও পথ জানা নেই কর্মীদের। |