কাগজের নৌকো
লালচে মেঘে ঢাকা আকাশটা দেখে বড্ড ভয় পাচ্ছিল টাবুন। সন্ধে থেকে কী যে হয়েছে আকাশটায়! অনবরত বিদ্যুৎ চমকে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। সঙ্গে হিলহিলে ঠান্ডা হাওয়া। মেঘের যা ঘনঘটা, এক্ষুনি না হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নেমে যায়!
সামনের ঘরে পড়ার টেবিলের সামনে টাবুন আর বুবুন বসে আছে। মা এসে খবর দিলেন, ‘অ্যাই, আজ স্যর আসবেন না। দমদমে মারাত্মক ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে।’
আজকাল সব জায়গায় এক সঙ্গে বৃষ্টি হয় না। দমদমে বৃষ্টি তো বেহালা একেবারে খটখটে।
স্যর আসবেন না শুনে টাবুন আর বুবুনের ভারী মজা হচ্ছে। স্যর মানেই টেবিলের উল্টো দিকে বসা রাগী গম্ভীর একটা মানুষ। মাঝে মাঝেই চোখ রাঙানি, ধমক। ও সব দেখলে শুনলে বুকটা বড্ড ঢিবঢিব করে।
মা বললেন, ‘স্যর আসবেন না মানে দুই ভাইয়ে খেলা নয়। তোমরা বই নিয়ে বসো। আমি এক্ষুনি পড়া ধরব।’
টাবুন, বুবুন জানে মা-ও কম রাগী নন।
মা পড়াতে বসলে বেশি ট্যাঁ-ফোঁ করা যাবে না। তক্ষুনি চোখ পাকিয়ে কান মলে দেবেন।
তবু স্যরের থেকে ভাল। মায়ের সামনে বসলে বুক তো আর ঢিবঢিব করে না। জল তেষ্টাও পায় না।
দুই ভাই বই নিয়ে বসে পাতা উল্টে যাচ্ছে। বুবুনের আবার একগাদা হোম টাস্ক রয়েছে। করে না নিয়ে গেলে ক্লাসের বাইরে নির্ঘাৎ নিল ডাউন। অদিতি মিস্ যা রাগী! একটাই রক্ষে, কাল স্কুল ছুটি।
ঠিক এমনি সময়ে তুমুল হাওয়ার মাতামাতি শুরু হল। আর ঝড়ের পরই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। একেবারে তেড়েফুঁড়ে।
মা চেঁচিয়ে বললেন, টাবুন, জানলাটা বন্ধ করে দাও।
ছবি: সুমিত্র বসাক
টাবুন কাজ পেয়ে দৌড়ে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করে দিল। তার পর বাইরে কী যে বৃষ্টি হল, বলার নয়। মাঝে মাঝে গুমগুম করে আকাশটা ডেকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে কড়কড়াৎ শব্দে বাজের আওয়াজ।
ঝড়-বৃষ্টি হলে বুবুন একেবারে কুঁকড়ে যায়। মা বারান্দার জানলা বন্ধ করে এ ঘরে এসে বুবুনকে কোলে তুলে নিলেন। বাইরে আকাশে মাঝে মাঝেই কড়কড়াৎ করে বাজ চমকাচ্ছে। ঝড় বৃষ্টি চলল অনেকক্ষণ। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। বাবা অফিস থেকে ফিরলেন একেবারে ভিজে একশা হয়ে।
আজ আর পড়াটড়া হল না। টাবুন বৃষ্টি থামলে জানলাটা ফাঁক করে দেখল কী থইথই জল জমে গিয়েছে রাস্তায়! অনেকেই জল ডিঙিয়ে যাচ্ছে। শব্দ হচ্ছে ছপাত ছপাত করে।
টাবুনের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল এক্ষুনি নীচে নেমে গিয়ে জলে কাগজের নৌকো ভাসায়।
বৃষ্টি হলে স্কুলে বন্ধুরা কাগজের নৌকো ভাসিয়ে দেয়। একটার পর একটা। খুব বৃষ্টি হলে রেনি ডে মাস্ট। ক্লাস হয় না, সবাই হইহই করে। সামনের বড় মাঠটায় জল থইথই করে। কেউ কেউ নেমেও পড়ে। ছপছপ করে জলের মধ্যে নৌকো ভাসায় অনেকেই। যদি অদিতি আন্টি এক বার দেখে ফেলেন, তক্ষুনি থমথমে গলায় এক বার বলবেন, ‘অ্যাই, সবাই চলে এসো।’
ব্যস, সবাই এক দৌড়ে ঢুকে পড়ে যে যার ক্লাসরুমে।
মা ঘরে নেই। কিচেনে ঢুকে বাবার জন্য চা করছেন। টাবুন টেবিলের এক পাশে এসে পুরনো খাতা থেকে খানকয়েক পাতা ছিঁড়ে নিল। তার পর নিচু হয়ে খান দুই-তিন নৌকো বানিয়ে ফেলল।
দাদা, নৌকো বানাচ্ছিস? একটা আমাকে দে না। বুবুন বলে উঠল, দে না দাদা।...
ঠোঁটে আঙুল দিয়ে টাবুন ফিসফিস করে বলল, আস্তে, একদম আস্তে। মা জানলে খুব বকবে। শ্... শ্...
স্কুলে সৌরভ, অনিন্দ্যরা পটাপট করে নৌকো বানাতে পারে। টাবুনও পারে। টুকরো কাগজগুলো ভাঁজ করে খানতিনেক নৌকো বানিয়ে ফেলল ও। দৌড়ে গিয়ে জানলাটা খুলে নীচের রাস্তাটা দেখল। এখনও থইথই করছে জলে। তাতে লাইট পোস্টের আলো পড়ে ঝিলমিল করছে।
এক বার নীচে নেমে জলে ভাসিয়ে দিলেই হল। হাওয়া পেয়ে তরতর করে এগিয়ে যাবে। ভাবতেই কী মজা
লাগছে টাবুনের। এক ছুটে নীচে নেমে পড়লেই হল।
এই যাঃ, মা আবার এই ঘরে আসছেন কেন? নিশ্চয় বলবেন, ‘পড়া না করে কী করছ তোমরা?’
কিন্তু এই ঝড় বৃষ্টিতে পড়তে কারই বা ভাল লাগে?
মা ঘরে ঢুকেই বুবুনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘বুবুন, হোম টাস্কগুলো করছ না কেন?’
মায়ের দিকে তাকিয়ে ফিচ করে হেসে উঠল বুবুন। তার পরই জিভ কামড়ে উঠল।
হোম টাস্কের কথা জিজ্ঞেস করতে হেসে উঠলে কেন বুবুন? কী ব্যাপার?
যাঃ, বুবুনটা সব গুবলেট করে দিল। টাবুন কী ভেবে রেখেছিল, আর কী হতে যাচ্ছে।
মা এক্ষুনি সব ধরে ফেলবেন। মায়েদের চোখকে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল।
বুবুন মায়ের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তো আছেই। দু’চোখের পাতা যেন পড়তেই চাইছে না।... ওর সামনে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসামাখা মুখে দাঁড়িয়ে মা।
কী ব্যাপার বুবুন? বলো... বলো...
দাদা তিনটে নৌকো বানিয়েছে। নীচের রাস্তায় জল জমেছে, না? ওখানে ভাসাবে বলে। বুবুন গড়গড় করে সব বলে দেয়।
এই রাত্তিরে? নৌকোগুলো কোথায়?
টেবিলের নীচ থেকে তিনটে নৌকো বার করে আনলেন মা।
এই রে, এক্ষুনি মা তিনটে নৌকো ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলবেন। সব দোষ বুবুনের।
মায়ের হাতে নৌকোগুলো। টাবুন ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখল নৌকোগুলো বুকের মধ্যে যেন চেপে ধরে আছেন মা। বললেন, ‘আজ এ সব বাদ দাও টাবুন। কাল তো ছুটি আছে, যদি কাল ঝেঁপে বৃষ্টি আসে, তা হলে নীচে গিয়ে ছেড়ে এসো। সাবধান, জলে কিন্তু নেমো না। ...আমরাও ছেলেবেলায় খুব বৃষ্টি হলে জলে এমনি করে নৌকো ভাসিয়ে দিতাম। তাই বলে পড়ায় ফাঁকি দিতাম না।’
টাবুন দেখল মা ভীষণ যত্নে নৌকোগুলো আঁকড়ে ধরে আছেন। চোখ দুটোয় হঠাৎ চিক-চিক করছে জল। মায়ের চোখে মুখে একটুও রাগ নেই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.