বছর পাঁচেক আগের কথা। বেঙ্গালুরুতে ‘ট্যুরে’ গিয়ে এক নামজাদা গেস্টহাউসে রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়েন এক কর্পোরেট তরুণী। কাঙ্ক্ষিত নিরাপদ পরিবেশ না-পেয়ে রাতেই নিজের অফিসে যোগাযোগ করে হোটেল পাল্টে দিতে বলেন তিনি। এর পরে সেই অতিথিশালার তরফে ক্ষমা চেয়ে তাঁকে নিরস্ত করার চেষ্টা হয়। কিন্তু মেয়েটি আর থাকতে চাননি।
কলকাতার এক তরুণী ক্রীড়াবিদের অভিজ্ঞতাও মোক্ষম! লখনউয়ে একটি নামকরা হোটেলের ঘরে হঠাৎ প্রবল ধাক্কাধাক্কি মাঝরাত্তিরে। ঘরটার এক পাশে ‘কানেক্টিং-ডোর’ আছে, আগে খেয়াল করেননি। ভয়ে রিসেপশনে ফোন করতেও তখন তাঁর হাত সরছে না। পরে মালুম হয়, পাশের ঘরে এক দম্পতি ভুল বুঝে দরজাটা খোলার চেষ্টা করছিলেন। সফরে বেরোলেই এখন হোটেলের ঘরটা আগে-ভাগে খুঁটিয়ে দেখে নেন ওই মেয়েটি।
দু’টি ঘটনাই ব্যতিক্রমী। কিন্তু ভিন্ শহরে একলা হোটেলে থাকার সময়ে অনেক মেয়েকেই সমস্যায় পড়তে হয়েছে। আজকের কর্পোরেট দুনিয়ায় ঘন ঘন ‘ট্যুর’ বা কেজো-সফরে বেরোতে হয় অনেক মেয়েকেই। তাঁদের সুবিধা-অসুবিধার খুঁটিনাটি আঁচ করে মহিলা-অতিথিদের মন জয়ে এ বার কোমর বাঁধছেন বেশির ভাগ বড়-মেজ হোটেল কর্তৃপক্ষ। |
হায়াত রিজেন্সি হোটেল-গোষ্ঠীর তরফে যেমন, মেয়েরা কী চান, আর চান না, তার একটা তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সেই মতো কলকাতা-সহ সর্বত্র মহিলাদের স্বাচ্ছন্দ্যের দাওয়াই ঠিক করেছেন তাঁরা। ঘরের পরিবেশ থেকে শুরু করে কী ধরনের খাদ্য-পানীয় তিনি পছন্দ করবেন, সে-দিকেও থাকছে সতর্ক দৃষ্টি। আইটিসি, ওবেরয়, তাজ, পার্ক-এর মত হোটেল-গোষ্ঠীও একলা মেয়েদের এটা-সেটা দরকারের বিষয়ে সচেতন হচ্ছে। বিভিন্ন হোটেলের সমীক্ষা বলছে, আমেরিকায় ম্যানেজমেন্ট বা ওই ধরনের চাকরিতে অর্ধেকের বেশি মহিলা। ভারতেও কর্পোরেট ক্ষেত্রে এখন শতকরা ৩০-৪০ শতাংশ মহিলা কর্মী। ন্যাসকম সূত্রের খবর, কর্মরত মহিলাদের কম-বেশি ১০ শতাংশকে নিয়মিত ট্যুরে বেরোতে হয়। ফলে, হোটেলে আপ্যায়নের ছকও পাল্টাতে হচ্ছে।
হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে পেশাদার কর্পোরেট-কর্ত্রীর নিরাপত্তার মাথাব্যথা তো থাকছেই! সেই
সঙ্গে হোটেল-কর্তাদের পর্যবেক্ষণ, পরিচ্ছন্নতা বা ঘরদোর সাজানোর নান্দনিকতার বিষয়ে মেয়েরা সাধারণত বেশি খুঁতখুঁতে। কিন্তু কথায়-কথায় মুখ ফুটে ফরমায়েশ করতে তাঁরা বিরক্ত হন। অতি পিটপিটে অতিথিরও কী কী দরকার হতে পারে আঁচ করে তাই মেয়েদের ঘরগুলো বিশেষ যত্নে সাজিয়ে থাকেন হোটেলওয়ালারা। ঘরে-বাইরে ব্যস্ত মহিলা শেষ মুহূর্তে কী কী টুকিটাকি ব্যাগে ভরতে ভুলতে পারেন তার খেয়াল রাখা, পেশাগত ক্লান্তি কাটাতে তিনি কী ধরনের পত্রিকা নাড়া-চাড়া করতে চাইবেন বা ঘরে কী ভাবে অবসর-যাপনে উৎসাহী হবেন, তা নিয়েও হোটেলে-হোটেলে গবেষণা চলছে। কে কী ‘এক্সক্লুসিভ’ পরিষেবার ব্যবস্থা রাখছেন, সেই তথ্যটুকু হোটেলওয়ালারা বাইরের লোকের কাছে ফাঁস করতেও রাজি নন।
গুগ্ল ইন্ডিয়া-র কর্পোরেট কমিউনিকেশন্স বিভাগের প্রধান পরমা রায়চৌধুরী এই নয়া খাতিরদারিতে সন্তুষ্ট। মাসে ৭-৮ দিনই দেশে-বিদেশে ট্যুরে ব্যস্ত থাকেন তিনি। বললেন, ছেলেদের দাড়ি-কামানোর সরঞ্জাম যদি হোটেলে মেলে, তা হলে মেয়েদের লম্বা চুল সামলানোর ব্রাশ-ট্রাশ ঘরে থাকাটাই তো স্বাভাবিক! উটকো ভিড় থেকে নিষ্কৃতি দিতে মুম্বইয়ের হোটেলে মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট ‘ডিভা ফ্লোর’-ও দেখেছেন পরমা। তবে মেয়ে বলে বাড়তি আদিখ্যেতায় তাঁর আপত্তি আছে। “আমার ভাল লাগবে ভেবে কেউ ঘরে টেডি বেয়ার সাজিয়ে রাখলে কিন্তু তাঁর কপালে দুঃখ আছে!” সহাস্যে বললেন পরমা।
মেয়েদের মূল চাহিদাটা তবে কী? মেয়েদের নিরাপত্তা এবং নিভৃতির প্রয়োজনটুকু বোঝা জরুরি— বলছেন টেবিল টেনিস তারকা পৌলমী ঘটক। বেশ ছোট বয়স থেকে এ দেশের বিভিন্ন শহরে বিস্তর নামী-অনামী হোটেলে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর। পৌলমীর কথায়, “মেয়েদের সুযোগ-সুবিধাগুলো বুঝতে এখনও বেশির ভাগ হোটেলেরই খামতি রয়েছে।” যেমন? সারা দিনের ধকল শেষে রুম সার্ভিসে মহিলা হোটেল-কর্মীর উপস্থিতি খুবই জরুরি বলে তিনি মনে করছেন। পোড় খাওয়া কর্পোরেট পেশাদারেরা পরামর্শ দিচ্ছেন, হোটেলে থাকতে হলে কয়েকটি দিক মাথায় রাখতেই হবে। বিরাট দালানের প্রান্তে আবছা-আলোর ঘর দিলে তা প্রত্যাখ্যান করো! কারও আচরণে সামান্য অসুবিধে হলেও মুখ খুলতে দ্বিধা কোরো না। পরমার কথায়, “লজ্জা পেয়ে এই অসুবিধেগুলো চাপতে গিয়েই ভবিষ্যতে নিজের বা অন্য কোনও মেয়ের জন্য আমরা বিপদ ডেকে আনি।”
পর্যটকদের নিরাপত্তার প্রশ্নে এ দেশের ভাবমূর্তি চাঙ্গা করতেও হোটেলে মেয়েদের স্বাচ্ছন্দ্য সুনিশ্চিত করার চেষ্টাটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। কলকাতা তো বটেই, ছোট শহরগুলোরও দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে। দুর্গাপুরের সিটি রেসিডেন্সি-র এমডি কবি দত্ত বলছেন, “অনেক মেয়েরাই অফিসের কাজে একটানা হোটেলে থাকছেন। ইদানীং দু’টি-একটি ঘর মহিলা অতিথিদের কথা ভেবেই অন্য ভাবে সাজানো হয়েছে।” |