বর্তমান ও প্রাক্তন মিলে রাজ্যের দুই মন্ত্রী, তৃণমূলের সুব্রত সাহা ও কংগ্রেসের মনোজ চক্রবর্তী টাইম মেশিনে চড়ে পৌঁছে গেলেন প্রায় চার দশক পিছনের কলেজ ক্যাম্পাসে!
সেখানে দুই মন্ত্রীর পাশে বসে আছেন সিপিএমের বহরমপুর গোরাবাজার লোকাল কমিটির সম্পাদক তরুণ মুখোপাধ্যায় এবং আরএসপি-র প্রাক্তন সাংসদ প্রমথেশ মুখোপাধ্যায়। টাইম মেশিন তাঁদের কাউকে চার দশক পিছনে নিয়ে গিয়েছে, কাউকে ছয় দশক। তার ফলে তাদের সবার চোখেই বর্তমান ছাত্র রাজনীতির পুরোটাই বড্ড অচেনা, বড় অস্বস্তিকর ঠেকছে। তাঁদের চোখে বর্তমান ছাত্র রাজনীতি, কলেজ ক্যাম্পাস, ছাত্র আন্দোলন সব যেন কেমন অদ্ভুত, অচেনা, অন্য কোনও গ্রহের ব্যাপার। বিরুদ্ধ মতাবলম্বী হলেও তাঁরা সবাই এই সময়ের, এই গ্রহের, এই জেলারই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তবু টাইম মেশিনে চড়ে অতীতে পৌঁছলেই বর্তমান সময়ের ছাত্র রাজনীতি তাঁদের সবার চোখেই কেমন কিম্ভুত ঠেকছে, কেন?
চার-পাঁচ দশক আগের কথা। ছাত্রপরিষদের দাপুটে নেতা সুব্রত সাহা এখন রাজ্যের খাদ্য প্রক্রিয়করণ ও উদ্যানপালন বিভাগের মন্ত্রী। তাঁর কলেজ জীবনেই উত্থান এসএফআই’র তার্কিক নেতা মইনুল হাসানের। এখন তিনি রাজ্যসভার সাংসদ। ছিলেন সদ্য প্রাক্তন কংগ্রেসের মন্ত্রী মনোজ চক্রবর্তী। আর ছিলেন এসএফআই নেতা ‘বেনুদা’ ওরফে তরুণ মুখোপাধ্যায় এখন সিপিএমর লোকাল কমিটির সম্পাদক। কিন্তু গত শতাব্দীর সাতের দশকের বিরোধী পক্ষের ছাত্রনেতাদের প্রতি এখনও ওঁরা পরস্পর শ্রদ্ধাশীল। সেই কাহিনি শোনা যাক বর্তমানের সুব্রত সাহার মুখে।
ঐতিহাসিক বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে তখন টানটান উত্তোজনা। ছাত্র সংসদ নির্বাচন সংক্রান্ত প্রচার প্রায় শেষ। একটা রিকশাভ্যান নিয়ে যাওয়া হল কলেজ ক্যাম্পাসে। সেটিই সভামঞ্চ। সুব্রতবাবু বলেন, “রিকশাভ্যানের মঞ্চ থেকে একে একে বক্তৃতা দিলেন আরএসপি-র ছাত্রশাখা পিএসইউ’র জয়ন্ত সাহা, সি পি এমের ছাত্রশাখার নেতা তিমির ঘোষ, নকশালপন্থী ছাত্রনেতারও। ছাত্রপরিষদের জেলা সভাপতি হিসাবে আমাকেও সেই মঞ্চ থেকে ভাষণ দিতে হয়েছে। এক মঞ্চ, কিন্তু সব পক্ষ শেখানে। সবার বক্তৃতেই পড়ে হাততালি। মগ্ন শ্রোতারা চুলচেরা বিশ্লেষনে ব্যস্ত। ভাবতে পারেন!” |
সৌহার্দ্যপূর্ণ ছাত্র রাজনীতির ক্লাইমাক্স অবশ্য আরও পরে। বহরমপুর বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তী বলেন, “বিদায় বেলার প্রচারের সব পক্ষ চায় তাদের শক্তি জহির করতে। ফলে যুযুধান প্রতিপক্ষের মিছিল কলেজ ক্যাম্পাসে মুখোমুখি হয়ে গেলে উত্তেজনা চরমে উঠে যেত। সেই উত্তোজনা প্রশমনে সব পক্ষের ছাত্রনেতার দু’টি মিছিলের মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে দেয়াল তুলে দিয়ে অতি উৎসাহী সমর্থকদের সামাল দিত। তার পর বহরপুর কলেজের ফকিরদার ক্যান্টিন, বা কৃষ্ণনাথ কলেজে বিজয়ের ক্যান্টিনে বসে সব পক্ষের ছাত্রনেতার এক সঙ্গে বসে চা খেত, টেবিল বাজিয়ে গান করত। আড্ডা দেওয়া চলতো।” সুব্রতবাবু বলেন, “এমনকী বিরোধী পক্ষের যে ভাল বক্তৃতা করতো তাঁকে ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে চা খাওয়ানোও হত। অথবা তার কাছে চা খাওয়ার আব্দার করা হত।” ওই পরিবেশের রসদ জুটতো কোথা থেকে? একদা ছাত্র নেতা, বর্তমানে সিপিএমের শ্রমিক ইউনিয়নের জেলা নেতা তরুণ মুখোপাধ্যায় বলেন, “তখন লড়াই ছিল নীতি-আদর্শের। তার ফলে বিরুদ্ধ পক্ষের বক্তৃতা মন দিয়ে শুনতে হত। তার পর তাকে কাউন্টার করার জন্য পড়াশুনা করতে হত। বিরুদ্ধ পক্ষের কেউ ভাল বক্তব্য রাখলে অকপটে তার তারিফ করার মানসিকতা তখন ছিল। ছিল ক্লাস লেকচারিং। এখনকার মতো কলেজ দখলদারি র রাজনীতির দাপট ছিল না তখন।” রাজনীতির সেই সুদিনের বদলে কলেজের দখলদারির রাজ কায়েম প্রসঙ্গে সুব্রত সাহা, প্রমথেশ মুখোপাধ্যায়, তরুন মুখোপাধ্যায় ও মনোজ চক্রবর্তীরা পৃথক ভাবে একই কথা বলেন। তাঁরা বলেন, “তখন ছাত্র রাজনীতি ছিল ভবিষ্যৎ রাজনীতিক তৈরির আতুরঘর। সেখানে ভবিষ্যৎ রজনীতিকের হাতেখড়ি হত। ফলে গুণমানে সেই ছাত্র রাজনীতি ছিল উচ্চমার্গের। এখনের মতো গোলাবারুদ হাতে দখলদারির রাজনীতি তখন ছিল না।” হারিয়ে যাওয়া সেই ছাত্র রাজনীতির অন্য ধণের কাহিনি শোনালেন প্রমথেশবাবু।
১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত কান্দি রাজ কলেজের ছাত্র রাজনীতির হাল ধরে ছিলেন বর্তমানে আর এস পি-র কেন্দ্রীয় সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য তথা প্রাক্তন সাংসদ প্রমথেশ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “আজকের দিনে বসে তখনকার ছাত্র রাজনীতির কথা কল্পনাই করা যাবে না! কান্দির রাজা বিমলচন্দ্র সিংহ তখন কংগ্রেসের মন্ত্রী সভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাঁর অনুগত ছিলেন কান্দি রাজ কলেজের অধ্যক্ষ ধীরেন্দ্রলাল দাস। রাজনীতিগত ভাবে তাঁরা বিরুদ্ধ পক্ষ হলে কি হবে তখন চিন আমাদের দেশকে আক্রমণ করেছে। মন্ত্রী ও অধ্যক্ষের আহ্বানে পিএসইউ-এর পক্ষ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তাঁদের মারফতে মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।”
প্রমথেশবাবু বলেন, “কলেজে বিভিন্ন মতাদর্শের ছাত্র-শিক্ষক মিলে নিয়মিত বির্তকসভা ও কলেজে পত্রিকা করা ছিল উৎসবের মতো ব্যাপার। একবার মন্ত্রী বিমলচন্দ্র সিংহের অনুগামী একদল ছাত্রের সঙ্গে পিএসইউ-এর ছেলেদের মারপিট হয়। তখনকার দিনে সেটি ছিল বেশ বড়সড় ঘটনা। অথচ দু’ পক্ষকে এক সঙ্গে বসিয়ে সেই বিবাদ মিটিয়ে দিয়েছিলেন ডানপন্থী অধ্যক্ষ ধীরেন্দ্রলাল দাস।” বামশাসনের শুরুর ৫-৭ বছর পর বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করতে কলেজের দখল নিতে শুরু করে শাসকদলের ছাত্রশাখা। অন্য পক্ষের মতে, কলেজের দখলদারির শুরুর শুরু ‘রিগিং’ করে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় রাজ্যের ক্ষমতা দখলের পর থেকে।
আজ সেই সব অতীতের কথা মনে পড়লে...এই চোখ রাঙানো বর্তমানে ফিরতে মন চায় না রে! সকলেই বলছেন, সমস্বরে। |