এই হতভাগ্য রাজ্যে ভাল ফলন কৃষকের পক্ষে অভিশাপ। এই বার রাজ্য জুড়িয়া টমাটোর ফলন ভাল হইয়াছে। চাষিরা প্রতি কিলোগ্রামে ৩০ পয়সাও দর পাইতেছেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার কাগজকলমে কৃষককে ‘আমাদের গৌরব’ বলিয়া দাবি করে বটে, কিন্তু সেই কৃষকের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নির্মাণের কাজটি কিছুই করিয়া উঠিতে পারে নাই। তবে শুধু তাঁহার সরকারের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া লাভ নাই। তাঁহার পূর্বসূরি মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসিয়াই বলিয়াছিলেন, তিনি রাজ্যে যথেষ্ট হিমঘর তৈরি করিবেন, গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুদয়নের কাজকে অগ্রাধিকার দিবেন, সড়ক তৈরি করিবেন, ইত্যাদি। প্রতিশ্রুতিপূরণের জন্য দশ বৎসর সম্ভবত কম পড়িয়াছিল। পশ্চিমবঙ্গের কৃষক, পরিবর্তনের আগে অথবা পরে, একই রকম অসহায় থাকিয়া গিয়াছেন।
টমাটো চাষিদের অসহায় অবস্থার কথা মুখ্যমন্ত্রীর কানে আসিয়াছে কি? আসিলে, তাঁহার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়াগুলি এই রকম ক) বিরোধীদের চক্রান্ত/সাজানো ঘটনা; অথবা খ) ছোট বাজারের ছোট ভুল; অথবা গ) অবিলম্বে সমস্ত টমাটো নির্দিষ্ট দরে কিনিয়া লও। প্রথম দুইটি প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু বলিবার নাই। তৃতীয় প্রতিক্রিয়াটি তাঁহার পূর্বসূরিদের পছন্দ হইবে বলিয়াই অনুমান। বিমান বসু ইতিমধ্যেই দাবি করিয়াছেন, যেহেতু আলু চাষিরা দাম পাইতেছেন না, তাই সরকার আলুর সহায়ক মূল্যের ব্যবস্থা করুক। কিন্তু রাজ্যের শাসক বা বিরোধী, কোনও গোত্রের বামপন্থীরাই মানিবেন না যে তাঁহাদের রাজনৈতিক অবস্থানটি কৃষকের স্বার্থবিরোধী। দানখয়রাতিতে কৃষকের লাভ নাই, কাঠামোগত পরিবর্তনই তাঁহাদের বাঁচাইতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে কৃষি পরিকাঠামো নির্মাণে উভয় পক্ষই ফেল মারিয়াছেন। বাজারের শক্তিকে আটকাইয়া রাখিয়া তাঁহারা কৃষকের সর্বনাশ করিতেছেন। বাজার তাহার নিজের স্বার্থেই কুশলী। সরকারের কুশলী হওয়ার দায় নাই। তাগিদও নাই, তাহা এত দিনে প্রমাণিত। কৃষক স্বার্থের দোহাই পাড়িয়াই মমতা খুচরো ব্যবসায়ে বিদেশি লগ্নির বিরোধিতা করিয়াছিলেন। আজ বিপর্যস্ত টমাটো চাষিরা তাঁহাকে প্রশ্ন করিতে পারেন আমাদের উন্নতির জন্য আপনি কী করিলেন?
বিদেশি পুঁজি আসিলে হিমঘর তৈরি হইত, সড়ক নির্মিত হইত। কোনও সদিচ্ছা হইতে নহে, জনকল্যাণার্থেও নহে নেহাতই ব্যবসায়িক লাভের খাতিরেই বৃহৎ পুঁজি এই কাজগুলি করিত। অ্যাডাম স্মিথ আজও প্রাতঃস্মরণীয়। আরও প্রয়োজন চুক্তি চাষ। আজ কৃষকরা ফসল ফলাইবার সময় জানেন না, ফসল পাকিলে বাজারের চেহারা কী হইবে। ফলে, চাষ করার সিদ্ধান্ত মানেই নিশ্চিত অনিশ্চয়তা। এই অনিশ্চয়তা অনেক ক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থে প্রাণঘাতী হইতেছে। চুক্তি চাষের ব্যবস্থা হইলে এই অনিশ্চয়তা হইতে মুক্তি। সরকার পরিকাঠামো গড়িতে পারে নাই। সে দায়িত্ব বেসরকারি পুঁজির উপর ছাড়িয়া দিক। সেই পুঁজি যাহাকে কৃষককে শোষণ না করিতে পারে, না ঠকাইতে পারে সরকার বরং তাহা নিশ্চিত করুক। |