আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিতে গিয়া মঙ্গলবার সুদীপ্ত গুপ্তের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে তাঁহার দিদি বলিয়াছেন, ভাই এতটা ‘সক্রিয় রাজনীতি’ করে জানিলে তিনি তাহাকে চড় মারিয়া বাধা দিতেন। একুশ বছরের তরুণের মৃত্যু এবং মৃতদেহ লইয়া যে বিপুল রাজনীতির নর্তনকুর্দন কলিকাতা শহরকে মথিত করিল, তাঁহার একান্ত প্রিয়জনের এই উক্তি তাহার গালে একটি প্রবল চপেটাঘাত। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন যে কোনও নাগরিক সুমিতাদেবীর এই অনুভূতির সহমর্মী হইবেন। সমস্যা একটিই। ক্ষুদ্র রাজনীতি শুভবুদ্ধিকে এতটাই গ্রাস করিয়াছে যে, এমন একটি ভয়াবহ প্রাণনাশের পরেও, এত শোরগোলের মধ্যেও মৌলিক প্রশ্নটি উঠিতেছে না। তাহা ছাত্র ইউনিয়ন নামক বস্তুটির চরিত্রে আমূল সংস্কারের প্রশ্ন। অথচ সেই সংস্কারের পথটি ইতিমধ্যে স্পষ্ট এবং স্বীকৃত। দেশ জুড়িয়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া দলীয় রাজনীতির যে সন্ত্রাস দেখা গিয়াছে, তাহার প্রতিকারের উদ্দেশ্যেই প্রথম ইউ পি এ সরকার সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ অনুসারে ২০০৫ সালে একটি কমিটি নিয়োগ করে। ভূতপূর্ব মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জে এম লিংডো’র নেতৃত্বাধীন এই কমিটি ২০০৬ সালে তাহার সুপারিশ দাখিল করে। গত সাত বছরে দেশের কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুপারিশগুলি রূপায়ণ করা হইয়াছে। পশ্চিমবঙ্গে এখনও এই বিষয়ে কার্যত কিছুই হয় নাই।
লিংডো কমিটির সুপারিশগুলির পিছনে মূল লক্ষ্য ছিল ছাত্র ইউনিয়নকে যথার্থ ভাবেই ছাত্রদের ইউনিয়নে পরিণত করা। কমিটির রিপোর্টে স্পষ্ট ভাষায় লেখা হইয়াছিল, এ দেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলি রাজনৈতিক দলের ‘রসদ সরবরাহ’ করিবার উপকরণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। প্রচলিত রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড হইতে ছাত্র সংগঠনকে বিযুক্ত করিবার পথ দেখাইয়াছিল এই কমিটি। যেমন, ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক দলের যোগ না দেওয়া, নির্বাচনে প্রার্থী হইবার শর্ত হিসাবে ন্যূনতম অনুপাতে ক্লাসে হাজির থাকা ইত্যাদি। শর্তগুলি যথেষ্ট কঠোর নহে, কিন্তু তাহাদের অভিমুখটি যথাযথ। সেই অভিমুখটিকে স্বীকার করিয়া কমিটির সুপারিশ হইতে আরও কয়েক পা অগ্রসর হওয়া জরুরি। যেমন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভিতরে দলীয় রাজনীতির কোনও ধরনের ক্রিয়াকলাপ অনুমোদন করা উচিত নয়। যেমন, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় বা অন্য ধরনের মূল্যায়নে যথেষ্ট সন্তোষজনক ফল না করিলে কোনও পড়ুয়ার ইউনিয়ন নির্বাচনে যোগ্যতা থাকা উচিত নয়। যেমন, নির্বাচনে সাধারণ ভাবে কেবলমাত্র অনার্স স্তরের ছাত্রছাত্রীদের প্রার্থী হইবার অধিকার থাকা বিধেয়, পাস কোর্সের পড়ুয়াদের জন্য বড়জোর অল্প কিছু আসন রাখা চলিতে পারে। এই সমস্ত শর্তের পিছনে যুক্তি একটিই। ছাত্রসমাজের প্রতিনিধিত্ব করিতে চাহিলে যথেষ্ট যোগ্য হইতে হইবে। এই প্রাথমিক লক্ষ্য অপূর্ণ থাকিলে ইউনিয়ন বেনো জলের অন্ধকূপ হইয়া উঠিতে বাধ্য, এবং সেই কূপে ক্ষুদ্র রাজনীতির পঙ্কিল আবর্তও অনিবার্য।
ক্ষুদ্র রাজনীতি এই সংস্কার মানিতে চাহিবে না, তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সেখানেই দূরান্বেষী শাসকের দায়িত্ব। বামপন্থীরা দীর্ঘ শাসনকালে শিক্ষার সমগ্র আয়োজনটিকেই দলতন্ত্রের সমিধে পরিণত করিয়াছিলেন। শিক্ষার উৎকর্ষ তাঁহাদের চিন্তায় কখনও স্থান পায় নাই। লক্ষণীয়, আজ তাঁহাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করিতেছে, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষায় উৎকর্ষ আনিবার জন্য সরকার বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির নিকট দাবি জানাইয়া আন্দোলন করিতেছে না। এই মানসিকতাতেই ‘পরিবর্তিত’ সরকারও সম্পূর্ণ অভিভূত। প্রকৃত পরিবর্তন চাহিলে তাঁহাদের আগে এই মানসিকতা ছাড়িতে হইবে। লিংডো কমিটি স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়াছিল, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক কাজ শিক্ষাদান, রাজনীতির পাঠ নয়’। এই প্রাথমিক সত্যটি বামপন্থীরা অস্বীকার করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্রাত্য বসুরাও এ-যাবৎ সেই অস্বীকারেরই শরিক। অনিল বিশ্বাস অবিনশ্বর। তাহা না হইলে ছাত্র ইউনিয়ন বিষয়ক আইনের আমূল সংস্কারে বর্তমান শাসকরা এখনও অগ্রণী হইলেন না কেন? বিধানসভায় তাঁহাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা তো অবিসংবাদিত! |