|
|
|
|
বণিকসভায় রাহুল-উদয়, চেনা খোলস ছেড়ে স্বপ্নের সওদাগর |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
এই রাহুল গাঁধীকে আমরা চিনতাম না। আজ এক ‘নতুন’ রাহুল গাঁধীর আত্মপ্রকাশ হল।
দুধ সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে যখন মঞ্চে উঠছেন, তখনও বোঝা যায়নি ঠিক কী হতে চলেছে। বোঝা যায়নি, পরবর্তী এক ঘণ্টায় কী ভাবে চেনা খোলস ছেড়ে নিজেকে একেবারে নতুন করে মেলে ধরবেন রাহুল।
বোঝা যায়নি, রাজধানীতে বণিকসভার মঞ্চ আজ এক ‘অন্য’ রাহুলকে দেখবে।
ক’দিন আগেও উত্তরপ্রদেশের এক নেতা দুঃখ করে বলছিলেন রাজ্যওয়াড়ি বৈঠক হল! ২০ থেকে ৩০ জন রাজ্যনেতা এক নাগাড়ে বকে গেলেন! আর রাহুল গাঁধী স্পিকটি নট! তিনি শুধু বললেন, ‘আমি সব শুনলাম!’ বস্তুত দলের সহ-সভাপতি হওয়ার পরে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বহু বৈঠক করেছেন রাহুল। কিন্তু তার সব ক’টিতেই তিনি মোটের উপর শ্রোতা।
অভিযোগ ছিল, রাহুল ন’বছর ধরে সাংসদ। কিন্তু দাগ কাটার মতো কোনও বক্তৃতা এত দিনেও সংসদে দেননি। জয়পুরে কংগ্রেসের অধিবেশনে বলতে উঠেছিলেন অবশ্য। কংগ্রেসকে আবার গোটা দেশের মানুষের সংগঠনে পরিণত করার কথা বলেছিলেন। আর শেষ দিনে দলীয় সহ-সভাপতি মনোনীত হওয়ার পরে একটা আবেগঘন ভাষণ দিয়েছিলেন।
কিন্তু আজকের রাহুল সে দিনের রাহুলকে ছাপিয়ে গেলেন! |
|
সিআইআই-এর মঞ্চে রাহুল গাঁধী। বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: রয়টার্স |
এই রাহুল মঞ্চের উপর প্রায় তারকা-অভিনেতার স্টাইলে এ-দিক থেকে ও-দিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এবং ঘুরতে ঘুরতে প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। চিন আর ভারতের তফাৎ বোঝানোর জন্য সামনে উপবিষ্ট সিআইআই-এর কর্তা অজয় শ্রীরামকে চট করে মঞ্চে ডেকে নিচ্ছেন। হাতের উপর হাত রেখে বলছেন, “এটা হল চিনে কায়দা!” তার পর মানুষটিকে হাত দিয়ে জড়িয়ে বলছেন, “এটা ভারতীয় কায়দা!” সুকৌশলে অমিতাভ এবং ঐশ্বর্যা রাই বচ্চনের নাম বলে বুঝিয়ে দিচ্ছেন আমজনতার পছন্দের চরিত্রগুলি সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল। দুই পরিবারের মধ্যে ভেদাভেদ সংক্রান্ত ধারণা তিনি জনমানসে গভীর হতে দিতে চান না! রাহুল আজ যেন এক স্মার্ট অধ্যাপক। ক্লাসরুমে একটা ‘প্রেজেন্টেশন’ দিচ্ছেন। কোথায় গেল খোঁচা খোঁচা দাড়ির মুখচোরা ছেলেটা?
কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতা বলছিলেন, ৪২ বছরের রাহুল কিন্তু নরেন্দ্র মোদী নন। মোদী এক জন সফল প্রশাসক হিসাবে প্রমাণিত। তিনি হ্যাটট্রিক-মুখ্যমন্ত্রী। সেই সাফল্যের উপরে দাঁড়িয়েই নরেন্দ্র মোদী এখন আরও বড় ভবিষ্যতকে করায়ত্ত করতে চাইছেন। রাহুল মুখ্যমন্ত্রী নন। দলের সভাপতি নন। গাঁধী পরিবারের স্টাইলে তিনি ধাপে ধাপে এগোচ্ছেন। হতে পারে, তিনি আজ এক নতুন ব্র্যান্ড রাহুলকে তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট গবেষণা করেছিলেন! হতে পারে, রাজ্যসভার সদস্য অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো কারও কারও কাছ থেকে তাঁদের ভাবনা ইনপুট হিসেবে তিনি গ্রহণ করেছেন! তার পর তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এক আধুনিক রাহুল গাঁধীকে, যে রাহুল গাঁধী একটা নতুন ভারত গড়ার স্বপ্ন দেখেন এবং স্বপ্ন দেখান।
রাহুলের ভাষায়, সেই ভারত কোনও ব্যক্তির হাতে (কারও কারও ধারণা, এটি নরেন্দ্র মোদীর প্রতি কটাক্ষ) গড়া হতে পারে না। রাহুলের ভারত গড়বে সাধারণ মানুষ। রাহুলের পর্যবেক্ষণ, ভারতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাটা সব মিলিয়ে কমবেশি ২০০ জন মানুষের হাতে কুক্ষিগত। তাঁরাই প্রায় ৫ হাজার বিধায়ক-সাংসদ বেছে নেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই প্রক্রিয়াটাকে নিচু তলার মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার সংকল্প নিতে চান তিনি। উত্তরপ্রদেশে নিজের নির্বাচন কেন্দ্রের এক ২৫ বছরের মায়ের গল্প শোনালেন রাহুল। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই মাঠে কাজ করেন। কিন্তু মায়ের স্বপ্ন, তাঁর এক সন্তান আইএএস হবে, অন্য জন ব্যবসায়ী। রাহুল তাঁকে বলেছিলেন, এটা বাস্তবসম্মত নয়! সেই মা ফুৎকারে রাহুলের কথা উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘আমরা সবাই কাজ করছি। আমাদের স্বপ্ন সন্তানেরা সফল করবে।’’
রাহুল মানুষের কাছে এই বার্তাটাই দিতে চাইছেন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নিজের উপর বিশ্বাস। সর্বগ্রাসী ‘সিনিসিজম’ আর হতাশার মাঝখানে রাহুল এসেছেন নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে। কংগ্রেস নেতা সলমন খুরশিদ বললেন, রাহুল হয়তো বয়স এবং অভিজ্ঞতায় একেবারে আনকোরা। কিন্তু মানুষের কাছে তাঁর ভাবমূর্তি নির্দোষ, কালিমাহীন।
এমন ভাবেই তো এক দিন ইন্দিরা গাঁধীর পর রাজীব গাঁধীকে দেখেছিল ভারত। শপথ গ্রহণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যিনি দলের কয়েক জন সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করেছিলেন। অবাঞ্ছিত মন্ত্রীদের সরিয়েছিলেন। প্রণববাবুকে অর্থমন্ত্রী পদ থেকে সরিয়েছিলেন (১৯৮৫ সালের এপ্রিল মাসে এক সাক্ষাৎকারে বলেওছিলেন, “অর্থমন্ত্রী পরিবর্তন করাটা খুব জরুরি ছিল”)। মায়ের আমলের আর কে ধবনকেও প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে বের করে দিয়েছিলেন রাজীব। রুগ্ণ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার চেয়ারম্যানদের ছ’মাসের ফরমান জারি করে বলেছিলেন, এই সময়ের মধ্যে উন্নতি ঘটাতে হবে, না হলে ইস্তফা দিতে হবে। বিধানসভার নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করে দিয়েছিলেন তাড়াতাড়ি। তৎকালীন রেলমন্ত্রী বংশীলাল, যিনি জরুরি অবস্থার সময় সঞ্জয় গাঁধীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁকেও রাজীব সরিয়ে দিয়েছিলেন। গুরুত্ব দিয়েছিলেন অরুণ নেহরু-অরুণ সিংহ-অমিতাভ বচ্চনের মতো মানুষকে। বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলেন আহমেদ পটেল আর অস্কার ফার্নান্ডেজকে।
শেষরক্ষা হয়নি অবশ্য। ১৯৮৭ সালেই বফর্স কেলেঙ্কারির অভিযোগ রাজীবের সাদা কাপড়ে কাদা ছিটিয়ে দিয়েছিল। বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহকে বিশ্বাস করে তিনি ঠকেছিলেন। কিন্তু সেই রাজীবই ভারতে ‘নো ননসেন্স’ পেশাদারিত্ব এনে নানা ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। তা সে স্যাম পিত্রোদাকে দিয়ে টেলিকম বিপ্লবই হোক, বা পঞ্চায়েতি রাজের বিকেন্দ্রীকরণ। ১৯৬০ সালে যেমনটা করেছিলেন আমেরিকায় জন এফ কেনেডি। মার্কিন টিভিতে ‘রাজীবের ভারত’ শীর্ষক এক তথ্যচিত্রে সাংবাদিক জ্যাক অ্যান্ডারসন তাই বলেছিলেন, ‘‘কেনেডির মতোই রাজীবের একটা ‘পাওয়ার অফ ক্যারিশমা’ আছে। এই ভাবমূর্তির ক্ষমতাকে ছোট করে দেখবেন না।’’
২০১৩ সালের সন্ধিক্ষণে আবার মঞ্চে সেই বাবার ছেলে। নিষ্কলুষ ভাবমূর্তি। তিনি যে ভারত গড়ার কথা বলেন, সেটা বহুত্ববাদী, আম জনতার ভারত। রাহুলের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা কতখানি, তা নিয়ে নানা জল্পনা হচ্ছে। কিন্তু রাজীব-তনয় ঘোষণা করে দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়া নয়, ভারত গড়াই তাঁর লক্ষ্য। রাহুল আজ বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনিও পারেন। তিনিও ভারতীয় রাজনীতির নবীন ‘কমিউনিকেটর’। |
|
|
|
|
|