রক্ত নেই শুনে হাসপাতালের দরজায় বসে ঝরঝর করে কাঁদছিলেন শান্তিলতাদেবী। স্বামীকে বাঁচানোর আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। তারপরে কপাল জোরে হাসপাতাল থেকেই খোঁজ মিলল নার্স হেনা ঘোষালের। হেনাদেবীর দেওয়া রক্তে প্রাণে বাঁচলেন শান্তিলতাদেবীর স্বামী বৈকুন্ঠ ঘোষ।
বুধবার নদিয়ার কালীগঞ্জের ভাগ্যবন্তপুর থেকে চিকিৎসার জন্য কাটোয়ায় আসেন ওই দম্পতি। কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে পরীক্ষার পরে দেখা যায় অবস্থা সঙ্কটজনক, রক্তে হিমগ্লোবিন পাঁচের নীচে। তখনই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক জেকে মণ্ডল জরুরি ভিত্তিতে শান্তিলতাদেবীর স্বামী বৈকুন্ঠ ঘোষকে দু’বোতল এবি পজিটিভ রক্ত দেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু এরপরেই হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কে গিয়ে শান্তিলতাদেবী জানতে পারেন ব্লাড ব্যাঙ্ক কার্যত রক্তশূন্য। মাত্র তিন বোতল নেগেটিভ রক্ত পড়ে রয়েছে সেখানে। রক্তের চিন্তায় মাথায় হাত পড়ে তাঁর। পাটকাঠির দেওয়াল আর ত্রিপলের ছাউনির সংসারে বাইরে থেকে রক্ত কিনে আনার মতো সামর্থ্য তাঁর ছিল না। সময়ও ছিল কম। অসুস্থ হয়ে পড়ায় বৈকুন্ঠবাবুর দিন মজুরির কাজও বন্ধ ছিল বেশ কয়েক দিন ধরে। সবমিলিয়ে ভাগীরথীর ভাঙনে যেভাবে তাঁদের জমি তলিয়ে গিয়েছিল সেভাবেই স্বামীর চিন্তায় একটু একটু করে পায়ের নীচের মাটি সরছিল তাঁর। |
শান্তিলতাদেবী বলেন, “বাড়িতে কেউ নেই। কাকেই বা রক্ত দিতে বলব, ভেবে কুল পাচ্ছিলাম না। হাসপাতালের গেটে বসে ঝরঝর করে কাঁদছিলাম। তখনই ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্মীরা সুপারকে সমস্ত কথা খুলে বলার পরামর্শ দেন।” এ দিকে রক্তের জন্য ক্রমাগত তাড়া দিচ্ছিলেন পুরুষ বিভাগের নার্সরা। আর কিছু না ভেবে তখনই কাটোয়া হাসপাতালের সুপার সোমনাথ মুখোপাধ্যায়কে গিয়ে সব কথা খুলে বলেন। সবটা শুনে সুপার ফোন করেন ওই হাসপাতালেরই নার্স বছর ছাপান্নর হেনা ঘোষালকে। কাটোয়ার তাঁতিপাড়ায় নিজের বাড়িতেউ ছিলেন হেনাদেবী। এ দিন নাইট ডিউটি ছিল তাঁর। সুপারের ফোন পেয়েই হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে চলে আসেন তিনি। এসেই সোজা চলে যান ব্লাড ব্যাঙ্কে। রক্ত দিয়ে প্রাণ বাঁচান বৈকুন্ঠবাবুর।
রাজ্যের অনেক হাসপাতালেই যেখানে নার্সদের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতি বা খারাপ ব্যবহারের অভিযোগ উঠছে সেখানে নার্সদেরই এক অন্য মুখ সামনে নিয়ে এলেন হেনাদেবী। রক্ত নেওয়ার পরে বৈকুন্ঠবাবু বললেন, “এর আগেও হাসপাতালের ডাক্তারবাবু আমায় ভর্তি হয়ে রক্ত নিতে বলেছিলেন। কিন্তু কী ভাবে জোগাড় হবে সেই ভয়ে ভর্তি হইনি। কিন্তু ওই নার্স আমার কাছে দেবী দুর্গা। শুধু আমারই নয়, সংসারের প্রাণটাও বাঁচিয়ে দিলেন উনি।”
কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালের সুপারও বলেন, “উনি আগেও বেশ কয়েকবার রক্ত দিয়েছেন। এবারও রক্ত সঙ্কটের কথা হেনাদেবীকে বলতেই উনি রোগীর প্রাণ বাঁচাতে এগিয়ে আসেন।”
হেনাদেবী অবশ্য তাঁকে নিয়ে এত হইচইয়ের কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। তাঁর কথায়, “মানুষের সেবা করাই আমাদের কাজ। প্রাণ বাঁচানোর জন্য রক্ত দেওয়া তো ধর্ম।” |