বলিউড বাদশার বাদশাহি বিনোদন।
নারিনের ‘নাকল’ বলে দিল্লি-দুর্দশার চালচিত্র।
চেনা গম্ভীরের মেঘ-গর্জন।
অপমানের পুরনো রেকর্ড থেকে শাপমুক্তি।
চৈত্রের গরমকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জয়ের আনন্দে রাতের ইডেনের আবেগ-স্নান।
টুকরো-টুকরো ছবি। কিন্তু কিং খানের কেকেআরের আইপিএল সিক্স সাফারির প্রথম ধাপের ভিন্ন ভিন্ন রং-কে যদি একটা নির্দিষ্ট ক্যানভাসে ধরতে হয়, উপরোক্ত পংক্তিগুচ্ছ মস্তিষ্কে ঘুরবে আপনাআপনি। |
আইপিএলের উদ্বোধনী ম্যাচের মেজাজ যা হওয়া উচিত, বোধনের মেনুতে বিরিয়ানি-কাবাবের ব্যবস্থাপনায় যা যা মশলা প্রয়োজনীয় বুধবারের ইডেনে সব ছিল। বেগুনি হুড দেওয়া সাদা টি শার্ট, ব্লু জিন্সে কিং খান যদি নাইটদের ‘চিয়ারলিডার ইন চিফ’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে থাকেন, তা হলে কেকেআরও ইডেন ছাড়ল নিজস্ব ঔদ্ধত্য নিয়ে। উদাহরণ: গম্ভীর। উদাহরণ: নারিন।
এবং বুধের মায়াবী রাতে বিনোদন ও ক্রিকেট দুই পৃথিবীতেই দিল্লির দর্পচূর্ণ কেকেআরের হাতে। মাঝরাতে শাহরুখ যখন দীপিকা পাড়ুকোনকে নিয়ে মাঠে ভিকট্রি ল্যাপ দিচ্ছেন, তখন কোথায় দিল্লি-বক্সের ‘সুপারস্টার’ অক্ষয়কুমার? কই টিভি ক্যামেরা তো একবারও ধরল না তাঁর মুখ? আবার বাইশ গজেও তাই। দিল্লি ধুলিস্যাৎ। মাহেলা ঘুরছেন মুখ চুন করে।
দিল্লি অধিনায়ক কী-ই বা করবেন? এত জঘন্য ব্যাটিং-বোলিং, ততধিক জঘন্য ফিল্ডিং দিয়ে ম্যাচ জেতা যায় না। পিচে নিয়ে অভিযোগের কোনও জায়গা নেই, গত চার বছরের চিরাচরিত লো বাউন্স ট্র্যাকের গল্প নেই। বরং ভাল বাউন্স আছে, বোলারদের সব প্রজাতির জন্যই আছে কিছু না কিছু। প্রমাণ নারিনের চার উইকেট। প্রমাণ লি-ভাটিয়ার দু’টো করে। বোলারদের পোয়াবারো বলে ব্যাটসম্যানের উইকেট দেখে মুখ গোমড়া হবে, এমনও নয়। এই উইকেটে রান আসবে, ব্যাটিংটা করতে জানলে। |
যা দিল্লির একা ‘কুম্ভ’ হয়ে একমাত্র মাহেলা (৫২ বলে ৬৬) করলেন। বিপন্ন টিমের (সহবাগ-কেপি-রাইডার-মর্কেলরা ছিলেন না) একমাত্র নাবিক হয়ে যে যুদ্ধ প্রশংসা দাবি করে, কিন্তু পকেটে মাত্র ১২৮ নিয়ে দুর্গ-রক্ষা হয় না। টি-টোয়েন্টির বাজারে ‘বেবি ফুড’-সম যে স্কোর নাইটরা পেরিয়ে গেল হাতে আট বল রেখে, অতি সহজে। মাঝেমধ্যে ছুটকো টেনশনের দু’একটা মুহূর্ত সৃষ্টি হলেও শেষ পর্যন্ত সসম্মানে উত্তীর্ণ। গত দু’বছরের আতঙ্কের রেকর্ডও তো আজ থেকে অতীত। যেখানে প্রথম ম্যাচ মানেই ছিল অবধারিত হার। কখনও চেন্নাই। কখনও দিল্লি। অভিশাপের শেষ এত দিনে। দু’বছর পর। শাপমুক্তি। ‘শুভ মহরত’ হতে আর কী লাগে?
যার সূচনায় নারিন। সমাপ্তিতে গম্ভীর। না, ম্যাচ শেষ করে আজ মাঠ ছাড়তে পারেননি নাইট অধিনায়ক। কিন্তু তাঁর ২৯ বলে ৪২ মনে পড়িয়ে দিয়েছে পুরনো গম্ভীরকে। টেস্ট টিম থেকে বাদ পড়ার যন্ত্রণা ছিল। কিন্তু কী ভাবে সেই যন্ত্রণাকে প্রত্যুত্তরের বারুদে বদলে ফেলতে হয়, সেটা তাঁর দিল্লির নামী সতীর্থদের কারও কারও ক্ষেত্রে শিক্ষণীয়। গম্ভীর এ দিন সবচেয়ে নির্দয় ছিলেন উমেশ যাদবের উপর। দিল্লির এক নম্বর পেসারের বলে এক-একটা করে বাউন্ডারি বিলবোর্ডে ধাক্কা খেয়েছে, আর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ফুটে উঠেছে অপার বিস্ময়-- ‘এ কি একই লোক, যে ইংল্যান্ড সিরিজে শুধু স্লিপে খোঁচা দিত?’ |
তবু গম্ভীর আজ পার্শ্বনায়ক। নায়ক কে, সেটা তো সাড়ে ন’টাতেই ঠিক হয়ে গেল। চার ওভারে ১৩ রানে কেউ চার উইকেট নিয়ে ফেললে, নতুন নায়ক বাছার আর উপায় থাকে?
নারিনের চারটে আবার চার রকম। ডেভিড ওয়ার্নার টার্নের কোনও হদিশ না পেয়ে ফার্স্ট স্লিপে ক্যাচ তুলে ফিরলেন। ভারতে তাঁর স্পিন খেলার ‘সুনাম’ অক্ষত রেখে। ইরফান পাঠান টাইমিংয়ের গণ্ডগোল বাধিয়ে লং অফে মনোজের হাতে লোপ্পা। রাসেলকে দেখে মনে হল না নারিন কী বস্তু, জানেন বলে। রিটার্ন ক্যাচ দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন ভ্যাবাচ্যাকা মুখে। নেহরারটা? থাক গে। তবু ভাবলেশহীন মুখে বিরতিতে ডাগআউটে ঢুকছিলেন নারিন। দেখলে আশ্চর্য লাগবে। কিন্তু ঘটনা হল, চার ওভারে চার উইকেট জাতীয় ব্যাপার ক্যারিবিয়ান মিস্ট্রি স্পিনারের জীবনে আর ব্যতিক্রম নয়। নিয়ম। |
যে নিয়মের খোঁজ তাঁর টিমেও পাওয়া যাচ্ছে। একেবারে প্রথম বলে ব্রেট লি-র ক্ষুধার্ত ক্ষেপণাস্ত্রে উন্মুক্তের স্টাম্প চুরমার, বহু দূর থেকে ছুটে বঙ্গজ লক্ষ্মীরতনের দুর্ধর্ষ ক্যাচ, মনোজের ছোট অথচ কার্যকরী ইনিংস দিল্লি ম্যাচকে সূচক ধরলে সবই তো একটা স্পষ্ট দিকনির্দেশের সন্ধান দিচ্ছে। বারেবারে বুঝিয়ে দিচ্ছে, আইপিএল ফাইভের তাজটা ফ্লুকে মাথায় ওঠেনি। উত্তরণের, নতুন শৃঙ্গ আরোহনের কাহিনি তো সবে শুরু। ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায়!’ |