সুদীপ্ত গুপ্তের মৃত্যু মর্মান্তিক। এই মৃত্যুর কার্যকারণসূত্র লইয়া যে ধরনের সংশয় দেখা দিয়াছে, তাহাও গভীর উদ্বেগের কারণ। অবশ্যই এই ঘটনার যথাযথ তদন্ত হওয়া জরুরি। বিরোধী শিবির হইতে বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি উঠিবে, ইহা অনিবার্য ছিল। বিচারবিভাগীয় তদন্তের উপর প্রশ্নহীন বিশ্বাস স্থাপনের কোনও কারণ নাই, বহু বিচারবিভাগীয় তদন্তের ইতিহাস শ্লাঘার কারণ নহে। আরও বড় কথা, এই ধরনের ঘটনার সত্যাসত্য নির্ধারণে বিচারপতিদের বিশেষ দক্ষতা কেন থাকিবে, তাহাও আদৌ স্পষ্ট নয়। বরং প্রশাসনিক ত্রুটির অভিযোগ যেখানে প্রধান বিচার্য, সেখানে প্রশাসনিক তদন্তই আদর্শ অবস্থায় যথাযথ। কিন্তু আদর্শ এবং বাস্তবের মধ্যে দূরত্ব বিপুল। পুলিশি তদন্তের প্রতি আস্থার পরিমাণ এই সমাজে খুব বেশি নয়। বামফ্রন্ট আমলেও ছিল না, এখনও নাই। থাকিবার কারণও নাই— প্রশাসনের সর্বোচ্চ এবং সর্বময় নেত্রী যদি পুলিশ তদন্ত শুরু করিবার আগেই আপন রায় ঘোষণা করেন, তবে আর আস্থা থাকে কী করিয়া? একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রশাসনের যে ভাবে কাজ করার কথা, প্রশাসন তাহা হইতে বিচ্যুত হইলে রাজধর্ম লাঞ্ছিত হয়। গণতন্ত্রও। প্রকৃত গণতন্ত্র বাঁচিয়া থাকে তাহার প্রতিষ্ঠানগুলির যথোচিত আচরণের উপর নির্ভর করিয়াই।
কথাটি গণতান্ত্রিক প্রশাসনের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও তেমনই সত্য। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে প্রতিবাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, বিতর্কের স্বাধীনতা। বিভিন্ন মত, বিভিন্ন যুক্তি, বিভিন্ন পন্থার পারস্পরিক টানাপড়েনের মাধ্যমেই গণতন্ত্র তাহার অগ্রগতিকে পরিচালনা করিবে, ইহাই প্রত্যাশিত। সেই বিতর্ক এবং প্রতিবাদের রূপ কখনও কখনও বড় আকারের জনসমাবেশে পরিণত হইতে পারে, যেমন সম্প্রতি ঢাকায় বা দিল্লিতে, গত দুই বছরে বারংবার কায়রোয়, কিংবা আরও কিছু বছর আগে ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমেরিকা সহ দুনিয়ার বহু দেশেই। কিন্তু সেই সব ঘটনা তাহাদের মূল চরিত্রেই বিশেষ, ব্যতিক্রমী, ঐতিহাসিক। যাহা ব্যতিক্রম, তাহা নিয়ম হইয়া উঠিলে গণতন্ত্র রাস্তার রাজনীতিতে পর্যবসিত হয়। তখন যে কোনও বিষয়ে প্রতিবাদ জানাইবার সহজ উপায় হইয়া দাঁড়ায় মিছিল, সমাবেশ, অবরোধ, বন্ধ। হরতাল বা অনশনের মতোই আইন অমান্য আন্দোলনও এ দেশে, বিশেষত এই রাজ্যে ক্রমশ যূথশক্তি প্রদর্শনের সহজ এবং সস্তা কৌশল হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ইহা গণতন্ত্র নয়, গণতন্ত্রের ময়ূরপুচ্ছধারী আস্ফালনতন্ত্র।
রাস্তার রাজনীতির বীজ নিহিত ছিল স্বাধীনতা-পূর্ব ইতিহাসেই, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের দীর্ঘ শাসন ও দীর্ঘতর রাজনৈতিক প্রভাব তাহাকে নিরন্তর লালন করিয়া বিষবৃক্ষে পরিণত করিয়াছে। ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই’ বলিয়া অহোরাত্র রাস্তায় নামিয়া পড়িবার নেশা সর্বস্তরে সমস্ত শিবিরের বঙ্গীয় রাজনীতিকদের মজ্জাগত হইয়াছে। যে কোনও দাবি, যে কোনও তর্ক মুহূর্তে দল পাকাইয়া রাস্তায় নামিয়া আসিলে যথার্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতির দাঁড়াইবার জায়গা থাকে না। ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচন লইয়া একের পর এক ভয়াবহ অশান্তির পরে সাময়িক ভাবে ইউনিয়ন নির্বাচন বন্ধ রাখা হইয়াছে। এই বিষয়ে ভিন্নমত থাকিতে পারে, কিন্তু সেই ভিন্নমতের ধ্বজা ধরিয়া উপাচার্যকে সারা রাত ঘেরাও করিয়া বসিয়া থাকা বা পথে নামিয়া আইন অমান্য আন্দোলন করার কোনও সুযুক্তি নাই। বিপ্লবের ফানুস উড়াইবার ব্যর্থ স্বপ্ন ইহাতে উৎসাহিত হইতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইহা নির্ভেজাল হঠকারিতা। বস্তুত, এই ধরনের হঠকারিতাই পরোক্ষে বুঝাইয়া দেয়, ছাত্র ইউনিয়নের রাজনৈতিক চরিত্র এবং তাহার অনুসারী নির্বাচনের আড়ম্বর কেন সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর। ছাত্র সংগঠন যদি তাহার যথাযথ গণতান্ত্রিক চরিত্রে সুস্থিত থাকে, তবে প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ইউনিয়ন তাহার নিজস্ব পরিধিতেই সীমিত থাকিবে, তাহাকে ‘ছাত্র রাজনীতি’র ভেক ধরিয়া দলতন্ত্রের খিদমত খাটিতে রাস্তায় নামিতে হইবে না, আইন অমান্যও করিতে হইবে না। সেই সুস্থ স্বাভাবিক গণতন্ত্রে সুদীপ্ত গুপ্তদের মর্মান্তিক মৃত্যুর আশঙ্কাও থাকিবে না। |