পাঁচ শতাংশের পাঁকে বৃদ্ধির চাকা বসে যাওয়া নিছকই সাময়িক। দেশের ভবিষ্যৎ আসলে বাঁধা রয়েছে ৮-৮.৫ শতাংশের কক্ষপথে। প্রায় সাত বছর পর বণিকসভা সিআইআইয়ের বার্ষিক সাধারণ সভা ও জাতীয় অধিবেশনের মঞ্চে বলতে এসে শিল্পমহলকে এই আশ্বাসই দিলেন মনমোহন সিংহ।
প্রধানমন্ত্রীর মতে, পরিস্থিতি প্রতিকূল। কিন্তু তা বলে এত আশাহত হওয়ারও কোনও কারণ নেই। ঠিক যেমন প্রবল আশাবাদী হওয়ার কারণ ছিল না ৯% বৃদ্ধিতে বুঁদ হয়ে থাকা ২০০৭ সালে। তাঁর দাবি, সব থেকে খারাপ সময় কাটিয়ে ইতিমধ্যেই মুখ তুলতে শুরু করেছে দেশের অর্থনীতি। তাকে চাঙ্গা করতে চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না কেন্দ্র। জোট রাজনীতির কোন্দল সত্ত্বেও সংস্কারের রথ যাতে দ্রুত গড়ায়, সেই চেষ্টাও জারি আছে পুরোদমে। তাই অর্থনীতির সুদিন ফেরা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা বলে মনে করছেন তিনি।
চিন ছাড়া বিশ্বের প্রায় সব দেশের তুলনাতেই ভারতের বৃদ্ধির হার যে এখনও ভাল, এ দিন ঘুরপথে তা ফের মনে করিয়ে দিয়েছেন মনমোহন। সেই সঙ্গে জোট-রাজনীতির সমস্যাকে অস্বীকার না-করেও সংস্কারের রথে সওয়ার থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। আশ্বাস দিয়েছেন ভর্তুকি ছেঁটে রাজকোষ ঘাটতি কমানোর রাস্তায় অবিচল থাকার। জানিয়েছেন, খুব তাড়াতাড়ি সংসদে আসবে জমি অধিগ্রহণ বিল। রাশ টানা সম্ভব হবে ডলার চলে যাওয়ার তুলনায় তা আসার ঘাটতিতেও। এ সবের সঙ্গে জোর দিয়েছেন আরও বেশি বিদেশি বিনিয়োগ টানা আর পরিকাঠামো নির্মাণে গতি আনার উপর।
প্রত্যাশিত ভাবেই এই আশ্বাসকে স্বাগত জানিয়েছে শিল্পমহল। কিন্তু কী ভাবে তা পূরণ হবে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় তা পুরোপুরি স্পষ্ট নয় বলে আক্ষেপও করেছে তারা।
মনমোহনও বিলক্ষণ জানতেন, পাঁচ শতাংশের তলানিতে ঠেকা বৃদ্ধির এই জমানায় শুধু আগামীর কথা শুনিয়ে শিল্পের আস্থা ফেরানো সহজ নয়। হয়তো সেই কারণে বক্তৃতার গোড়াতেই ৭ বছর পিছিয়ে গিয়েছেন তিনি। মনে করিয়ে দিয়েছেন, “এর আগে ২০০৭ সালে শেষ বার এই অনুষ্ঠানে এসেছিলাম আমি। তখন প্রায় টাট্টু ঘোড়ার মতো দৌড়চ্ছে দেশের অর্থনীতি। ৯% বৃদ্ধিতে ‘অভ্যস্ত’ হয়ে যাওয়া শিল্প মনে করছে সরকার না থাকলেও চলে। লেম্যান-ব্রাদার্সের পতন তখনও প্রায় এক বছর দূরে। আমি কিন্তু তখনই বলেছিলাম, এতটা আশাবাদী হওয়াও বোধ হয় ঠিক নয়। বরং বেতন থেকে শুরু করে বিভিন্ন খরচে রাশ টানার এটাই সময়। তখন অনেকে ভেবেছিলেন অকারণে উদ্বিগ্ন হচ্ছি আমি।” প্রধানমন্ত্রীর মতে, ওঠা-পড়া যে কোনও অর্থনীতিতেই স্বাভাবিক।
তাই ২০০৭-এর ওই লাগামছাড়া আশা যেমন বাড়াবাড়ি ছিল, তেমনই আজকের এত হতাশাও কিছুটা অকারণ।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় শ্রোতার আসনে ছিলেন গোদরেজ গোষ্ঠীর কর্ণধার আদি গোদরেজ, ইনফোসিসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এস গোপালকৃষ্ণন, ভারতী-এয়ারটেলের শীর্ষ কর্তা সুনীল মিত্তলের মতো দেশের এক ঝাঁক প্রথম সারির শিল্পপতি। তাঁদের সামনে এ দিন প্রথমে শিল্পের মনোবল বাড়ানোর মতো কথা বলার পর পুরোপুরি নিজের ‘পুরনো’ অর্থনীতিবিদের জোব্বায় সেঁধিয়ে গেলেন মনমোহন।
এক দিকে তুলে ধরলেন শিল্প তথা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কেন্দ্রের পদক্ষেপের খতিয়ান। অন্য দিকে তুলে আনলেন আগামী দিনের সম্ভাবনার কথা। ঝানু অধ্যাপকের মতো পুরোটাকেই বেঁধে রাখলেন নিখাদ যুক্তির বুনোটে।
আস্থা তলানিতে ঠেকা শিল্পকে স্বাভাবিক ভাবেই কিছুটা অন্তত আশ্বস্ত করেছে প্রধানমন্ত্রীর এ দিনের বয়ান। কিন্তু বাস্তবে ওই সব প্রতিশ্রুতি (বিশেষত সংস্কারের) কতটা রাখা যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে তাদের মনে। তৃণমূল কংগ্রেস আগেই সরকার ছেড়েছে। সম্প্রতি সম্পর্কে দাঁড়ি টেনে দিয়েছে ডিএমকে। বেসুরো গাইছেন মুলায়ম সিংহ যাদবও।
এই পরিস্থিতিতে শিয়রে লোকসভা ভোট নিয়ে অর্থনীতির প্রয়োজনে কোনও অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেওয়া কেন্দ্রের পক্ষে কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে সন্দিহান শিল্পপতিদের অনেকেই।
তবে ফের আলোয় ফেরার আশায় আপাতত অর্থনীতিবিদ মনমোহনের উপরই ভরসা রাখছেন তাঁরা। |