স্বামীর দ্বারা স্ত্রীর ধর্ষণ? হয়? হতে পারে? একশোটা দেশ মনে
করে: হয়। ভারত এখনও সেই তালিকায় নেই। লিখছেন
দোলন গঙ্গোপাধ্যায় |
মধুসূদন বললে, ‘বড়োবউ কাপড় ছেড়ে শুতে আসবে না?’
কুমু ধীরে ধীরে উঠে পাশের নাবার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলে... মুক্তির মেয়াদ যতটুকু পারে বাড়িয়ে নিতে চায়।...
একটু পরেই আস্তে আস্তে দরজা খুলে গেল। কুমুদিনী বেরিয়ে এল, যেন সে স্বপ্নে পাওয়া।...
কুমু বললে, ‘এখনও আমার মন তৈরি হয় নি। আমাকে একটুখানি সময় দাও।’ মধুসূদনের মনটা শক্ত হয়ে উঠল;... কড়া করেই বললে, ‘সময় দিলে কি সুবিধা হবে! তোমার দাদার সঙ্গে পরামর্শ করে স্বামীর ঘর করতে চাও!’...
‘তাঁর হুকুম না হলে আজ কাপড় ছাড়বে না, বিছানায় শুতে আসবে না! তাই নাকি?’... কুমু কোনো জবাব না দিয়ে ছাতে যাবার দরজার দিকে চলল।
মধুসূদন গর্জন করে ধমকে উঠে বললে, ‘যেয়ো না বলছি।’
কুমু তখনই ফিরে দাঁড়িয়ে বললে, ‘কী চাও, বলো।’
‘এখনই কাপড় ছেড়ে এসো।’ ঘড়ি খুলে বললে, ‘পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি।’
আজ থেকে শ’খানেক বছর আগে ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ নায়িকা কুমুর বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে ধর্ষণের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বিয়ের মধ্যে ধর্ষণ কোনও নতুন কথা নয়। সনাতন পুবের সতীলক্ষ্মীদের খেপিয়ে তোলার জন্য পশ্চিম থেকে ভেসে আসা নারীবাদের কোনও নতুন চালও নয়। শতাধিক বছর আগের কুমু থেকে শুরু করে একবিংশের আধুনিকাও এর শিকার। ইউ এন এফ পি এ-এর পরিসংখ্যান অনুসারে, ভারতে ১৫ থেকে ৪৯ বছরের বিবাহিত মেয়েদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই বিয়ের মধ্যে মারধর, ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন ভোগ করে। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-৩ (’০৫-০৬) অনুযায়ী, এ দেশে প্রতি দশ জনে এক জন মেয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়, চার জন স্বামীর যৌন অত্যাচার সহ্য করে।
বহু কর্মশালায় দেখা গেছে, সারা দিনের কাজের তালিকা তৈরি করতে বললে মেয়েরা ঘর-বারান্দা পরিষ্কার থেকে শুরু করে বাসন মাজা, কাপড় কাচা, রান্না, বাচ্চার দেখাশোনার সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে রাতে ‘বিছানার কাজ’-এর কথা উল্লেখ করেন। সমস্ত দিনের খাটুনির পর সে কাজে তাঁদের ক্লান্তি, অনীহার কথাও খোলাখুলি বলেন। সে কাজ করতে না চাইলে বেদম প্রহারের অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেন বারংবার। |
অথচ আমাদের সরকার সম্পর্কের মধ্যে ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে স্বীকার করতে নারাজ। বর্মা কমিটি বিয়ের মধ্যে ধর্ষণকে আইনের আওতায় আনার সুপারিশ করেছে। কিন্তু ভারত সরকার অনড়। আসলে যৌন সঙ্গম স্ত্রীর কাছে যে আকছার ধর্ষণে পরিণত হয়, এ কথা মেনে নিলে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটির গোড়ায় কুঠারাঘাত করা হয়। তাই বোধহয় সরকার এ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে করেছে।
মেনে নেওয়া ভাল যে, মেয়েদের পক্ষে বিয়ে বেশির ভাগ সময়ই একটা জাঁতাকল। প্রেম এবং পরম্পরার নামে নারীর শ্রমশক্তি এবং যৌনশক্তিকে ব্যবহারের জাঁতাকল। বিয়ের পবিত্র বন্ধনের দোহাই দিয়ে মেয়েদের স্বামীর ইচ্ছায় বিছানায় যেতে বাধ্য করা হয়, পরিবার পরিজনের চাপে মা হতেও বাধ্য করা হয় অনেক সময়। ছোটবেলা থেকেই তাদের শেখানো হয়, স্বামীর যৌন-আহ্বান কখনও ফেরাতে নেই, তা হলেই স্বামী যৌনপল্লীতে গিয়ে উপনীত হবে! পাশাপাশি, এই শিখেই মেয়েরা বড় হয় যে, যৌন সম্পর্কে মত দেওয়া ‘মন্দ মেয়ে’র লক্ষণ। আর ছেলেরাও আশৈশব শেখে, বউকে যখন-তখন শুতে বলাই স্বামীর ভালবাসা প্রকাশের উপায়। বউ বলে প্রাণীটির যে এ ব্যাপারে একটা মতামত থাকতে পারে, তা তাদের জীবনশৈলীর সিলেবাসে নেই। ফলে অধিকাংশ মেয়েই বৈবাহিক সম্পর্কে নিয়মিত ধর্ষণের শিকার হয় এবং এও তাদের একটি ‘কাজ’ ভেবে চুপ করে সহ্য করে। আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজও এই মূল্যবোধই পোষণ করে। কারণ তাতেই তাদের সুবিধা। মেয়েরা মুখ বুজে গর্ভধারণের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে, দেশের নাগরিক উৎপাদনের গুরুদায়িত্ব পালন করছে বিয়ের মধ্যে ধর্ষণের সম্ভাবনাকে মেনে নিলে সে বন্দোবস্তে বিঘ্ন ঘটবে। তাই বিয়ের মধ্যে যৌন-জুলুমকে আমল দেওয়া হয়না।
অথচ ১০০টি দেশ বিবাহের মধ্যে ধর্ষণের আইনি প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করেছে। ভারত সহ চারটি দেশ কেবল আইনি বিচ্ছেদ (সেপারেশন) পর্বে স্বামীর ধর্ষণকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ দেশে পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে (২০০৫) বিবাহিত সম্পর্কের মধ্যে ধর্ষণের উল্লেখ আছে বটে, কিন্তু এ আইন ফৌজদারি দণ্ডবিধির অন্তর্ভুক্ত নয়, অর্থাৎ এ আইন ভঙ্গের ফলে স্বামীর কোনও শাস্তি হবে না।
বিশ্ববাজারে ভারত প্রগতিশীল গণতন্ত্র হিসেবে নাম কিনেছে। কিন্তু ব্যক্তি-নারীকে কী প্রগতির খাতায়, কী গণতন্ত্রের খাতায় স্থান দিতে এ দেশের সরকার এখনও নারাজ। দাম্পত্য সম্পর্কের চৌহদ্দির মধ্যে মেয়েদের অধিকারের বুলি, সে অধিকার যদি আবার শরীরের অধিকার হয়, মেনে নিতে আমাদের গণতান্ত্রিক সরকারের প্রভূত অনিচ্ছা। মেয়েকে একক এবং স্বাধীন নাগরিক হিসেবে নিরাপত্তা দিতে অক্ষম ভারতীয় গণতন্ত্র। |