বহুসংস্কৃতিবাদ বিষয়টি লইয়া আবার গোড়া হইতে ফিরিয়া ভাবিতে হইবে বেচারি ফ্রান্সকে। জটিল বিষয়টিকে এমনিতেই তাহারা জটিলতর করিয়াছিল নানা সংস্কার ও নিষেধাজ্ঞা দিয়া, যাহার অন্যতম: মুসলিম মহিলাদের মস্তক-আবরণী নিষিদ্ধকরণ। বলিয়াছিল, মূলস্রোতে না মিশিলে সংস্কৃতির ‘মিলন’ হয় না, এবং মূলস্রোতে মিশিবার পথ ভিন্নগামী আচার-আচরণ কমানো, কিংবা বর্জন! ক্রমশই সে দেশে দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকদের গুরুত্ব বর্ধমান, এমনকী সমাজবাদী দল বলিয়া যাহারা পরিচিত এবং শাসক দল হিসাবে নির্বাচিত, ইসলামি সমাজ বিষয়ে তাহাদেরও দৃষ্টিভঙ্গি অনমনীয়, ফরাসি সমাজ-মানসের সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি এতটাই তীব্র বিভেদ-অসহিষ্ণুতার শিকার হইয়া পড়িয়াছে।
এমনই চলিতেছিল, হঠাৎ গোল পাকাইল একটি সাম্প্রতিক সংবাদ। স্কুল হইতে কলেজে উত্তরণের সময় যে পরীক্ষা সকল ফরাসি ছেলেমেয়েদের দিতে হয়, সেই পরীক্ষার ফলাফলে এ বার দেখা যাইতেছে, সর্বাপেক্ষা সফল একটি ইসলামি স্কুল। উত্তর ফ্রান্সের লাইল-এর শহরতলি অঞ্চলে স্কুলটি ১০০ শতাংশ সাফল্য লাভ করিয়াছে, যাহা অনেক প্যারিসীয় স্কুলও লাভ করিতে পারে নাই। আরও দুইটি তথ্য এই সূত্রে গুরুত্বপূর্ণ: এক, এই স্কুলের প্রায় সকল ছাত্রছাত্রীই আসিয়াছে সমাজের দুঃস্থ বর্গ হইতে, মুসলিম ‘গেটো’ বলা হয় যে সকল অঞ্চলকে, সেখান হইতে। এবং দুই, এই স্কুলটি পরিপূর্ণ ভাবেই ইসলামি প্রথায় চলে, মূলস্রোতের সংস্কৃতির সহিত ইহার যোগ বলিতে প্রধানত পরীক্ষা এবং পড়াশোনা। স্কুল কর্তৃপক্ষ জানাইয়াছেন, গত পাঁচ বৎসর এই অভিমুখে যাত্রা করিতেছেন তাঁহারা, যে অভিমুখের নাম: উৎকর্ষ। যখন হইতে ফরাসি সমাজে ইসলাম-বিরোধিতার বাড়াবাড়ি অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে, তখন হইতেই তাঁহাদের এক ও একমাত্র লক্ষ্য, ইসলামি হইয়াও যে উৎকৃষ্ট হওয়া যায়, ভিন্নধর্মী ও ভিন্নাচারী হইয়াও যে মূলস্রোতে সফল হওয়া যায়, তাহা প্রমাণ করা।
বিভিন্ন সমাজের প্রত্যন্ত বিভিন্ন রকমের। ফরাসি সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে ভাবিলে, এই স্কুলের যে জনচরিত্রগত গঠন তাহা প্রাত্যন্তিক সমাজ ভিন্ন কিছু নহে। যে কোনও সমাজেই প্রত্যন্তের বাসিন্দারা মূলস্রোতে সাফল্য অর্জন করিতে পারিলে তাহা অতীব শুভসংবাদ, সমাজটির চলিষ্ণুতার প্রমাণ। ফ্রান্সের ক্ষেত্রে এই প্রত্যন্ত-সংবাদের গুরুত্ব আরও বেশি। তাহার কারণ, প্রত্যন্ততা এখানে বহু প্রকারের: অশ্বেতকায়, ইসলামি, অর্থনৈতিক ভাবে পশ্চাৎপর এবং অনেকাংশে অ-ইউরোপীয়। প্রান্তের এই কেন্দ্রজয়ের সংবাদ তাই অন্তত চারগুণ বেশি গুরুতর। আশা করা যায়, রাজনীতিকরা ও সমাজতাত্ত্বিকরা বিষয়টি লইয়া চারগুণ বেশি ভাবিত হইয়া পড়িবেন, ফরাসি রাজনীতির সাংস্কৃতিক ভিত্তিটি আরও নমনীয় ও প্রসারিত করিবেন। হয়তো তাঁহারা বুঝিতে পারিবেন, ‘মূলস্রোত’-এর শৃঙ্খলবদ্ধতায় বাঁধিবার চেষ্টা না করিয়া বহু স্রোতের বহতা ধারাকে জাতীয় উৎকর্ষের লক্ষ্যে দিব্য বহাইয়া দেওয়া যায়। |