কোরীয় উপদ্বীপে যুদ্ধের দামামা। বাজাইয়াছেন প্রাথমিক ভাবে উত্তর কোরিয়ার সর্বময় কর্তা কিম জং-আন, যিনি প্রথম যৌবনেই পিতা কিম জং-ইল-এর প্রয়াণে সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রনায়কের সিংহাসনে আসীন হইয়াছেন। তাঁহার এই রণোন্মাদনার নেপথ্যে হয়তো রহিয়াছে ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি আয়ত্ত করার ক্ষেত্রে উপর্যুপরি কৃতিত্ব এবং পরমাণু বোমা নির্মাণের মরিয়া প্রয়াসে নূতন সাফল্য। অন্তত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করিলে এমন অনুমানের বিলক্ষণ কারণ আছে যে, ওবামা প্রশাসন উত্তর কোরিয়ার এবারকার রণসাজকে একেবারেই হাল্কা করিয়া দেখিতেছে না। পিয়ংইয়াংয়ের হুমকিকে গুরুত্ব দিয়া মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর দেশের প্রশান্ত মহাসাগরীয় পশ্চিম সীমান্ত সুরক্ষিত করিতে ডজনখানেক অতিরিক্ত ক্ষেপণাস্ত্র-নিরোধক জবাবি সামরিক ব্যবস্থা মোতায়েন করিয়াছে। কোরীয় উপদ্বীপের সংঘাতকে প্রশান্ত মহাসাগর পার করাইবার পরিকল্পনাটি অবশ্য কিম-জং আন-এর, দক্ষিণ কোরিয়াকে ‘ধ্বংস’ করার পাশাপাশি তাহার মহাশক্তিধর অভিভাবক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘শিক্ষা’ দিবার অভিপ্রায় যে-পরিকল্পনার অন্তর্গত।
যুদ্ধের প্ররোচনা একতরফা নয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সহিত আমেরিকার যৌথ সামরিক মহড়া এবং সেই সূত্রে কোরীয় উপদ্বীপে পারমাণবিক মারণাস্ত্র নিক্ষেপে সক্ষম মার্কিন বোমারু বি-৫২-র আমদানি উত্তরের যুদ্ধবাজ একনায়কের স্পর্শকাতরতাকে উসকানি দিয়াছে নিশ্চিত। এই বিপুল এবং ভারসাম্যহীন মার্কিন শক্তি-প্রদর্শনের প্রয়োজন ছিল কি না, তাহা লইয়া তর্ক থাকিতেই পারে। তবে মার্কিন মহড়ার পিছনে কেবল উত্তর কোরিয়াকে সন্ত্রস্ত ও সতর্ক করার অভিপ্রায়ের অতিরিক্তও কিছু থাকা সম্ভব। পূর্ব ও দক্ষিণ চিন সাগরে ইদানীং বিভিন্ন দ্বীপের দখল লইয়া গণপ্রজাতন্ত্রী চিন মার্কিন-মিত্র দেশগুলির সহিত যে আচরণ করিতেছে, তাহার নিরিখে চিনকে চাপে রাখা কিংবা বার্তা দেওয়াও আমেরিকার উদ্দেশ্য হইতে পারে। উত্তর কোরিয়া ও তাহার একনায়ক বংশপরম্পরায় বেজিংয়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র (বস্তুত, চিনই বিশ্বে পিয়ংইয়াংয়ের একমাত্র বন্ধু) এবং বেজিংয়ের জোরেই কিম জং-আন-এর যাবতীয় আস্ফালন। পরমাণু বোমা কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি আয়ত্ত করা হইতে তাঁহাকে নিরস্ত করিয়া নিরস্ত্রীকরণ আলোচনার টেবিলে বসাইবার দায় চিনেরই ছিল। কিন্তু চিনা কমিউনিস্ট নেতৃত্ব সে কাজে সফল হন নাই, হয়তো পিয়ংইয়াংকে নিবৃত্ত করিতে চাহেনও নাই। চাহিলে পারিতেন না, ইহা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কেননা উত্তর কোরিয়ার আড়াই কোটি বুভুক্ষু মানুষের অন্নদাতা চিনই, তাহার এই প্রতিবেশীর অহমিকা গগনচুম্বী হইলেও অর্থনীতি, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য বলিয়া কিছু নাই, বেজিংই তাহাকে প্রতিপালন করে।
মুশকিল হইয়াছে দক্ষিণ কোরিয়ার। সেই দেশের জনসাধারণ উত্তরের জ্ঞাতিভ্রাতাদের সহিত অনিচ্ছাকৃত শত্রুতার বন্ধনে বাঁধা পড়িয়াছেন। ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান হইলেও বিভক্ত, দ্বিখণ্ডিত কোরিয়ার একীকরণের কোনও সম্ভাবনা নাই, নিজেদের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও গণতন্ত্রকে বিদায় করিয়া উত্তরের একনায়ককে শাসক রূপে শিরোধার্য করারও প্রশ্ন নাই। আবার ইতিহাসের জের টানিয়া মার্কিন রণনীতির অঙ্গীভূত থাকার নিয়তিও সে দেশের পক্ষে মোচন করা সম্ভব নয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় এই প্রথম এক জন মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হইয়াছেন। তিনি যথাসাধ্য কোরীয় জাতীয়তাবাদ উসকাইয়া দেশবাসীকে চাঙ্গা রাখিতে সচেষ্ট। কয়েক বছর আগে উত্তরের আক্রমণে দক্ষিণের বহু নাবিকের মৃত্যুর মর্মান্তিক ঘটনা এখনও স্মৃতিতে অম্লান। তেমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাহাতে না হয়, দুই কোরিয়ার মধ্যে কোনও ক্রমেই যাহাতে যুদ্ধ না বাধে, তাহা নিশ্চিত করার দায় এখন আমেরিকা ও চিনের উপরেই। ওবামা প্রশাসন মনে রাখিলে ভাল করিবে, পিয়ংইয়াংয়ের হারাইবার কিছু নাই। দেউলিয়া, দুর্দশাগ্রস্ত, মরণোদ্যত এই আত্মঘাতী রাষ্ট্র ও তাহার একনায়কদের দায়িত্বজ্ঞানহীন উচ্চারণ ও আচরণ তাই শোভা পায়, চিন বা আমেরিকাকে পায় না। বিশ্বের এই দুই বৃহৎশক্তিরই উচিত, সম্ভাব্য যুদ্ধের কিনারা হইতে দুই কোরিয়াকে ফিরাইয়া আনিতে যত্নবান হওয়া। |