|
|
|
|
জেলের পথে দুর্ঘটনা |
ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কার পর কি মার পুলিশের |
নিজস্ব সংবাদদাতা |
আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রাণ গেল এসএফআই-এর এক তরুণ নেতার। সুদীপ্ত গুপ্ত নামে সংগঠনের রাজ্য কমিটির ওই সদস্যকে যখন মঙ্গলবার দুপুরে ধর্মতলা থেকে আরও কয়েকশো সমথর্র্কের সঙ্গে গ্রেফতার করে প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সেই সময়ে পথেই গুরুতর আহত হন তিনি। দুপুরেই তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সন্ধ্যায় মারা যান সুদীপ্ত (২২)।
কী ভাবে সুদীপ্তর মৃত্যু হল, তা নিয়ে পুলিশ এবং সিপিএমের মধ্যে চাপানউতোর শুরু হয়েছে। এসএফআই-এর অভিযোগ, পুলিশের মারেই মৃত্যু হয়েছে এমএ পাঠরত ওই ছাত্রের। কিন্তু পুলিশ বলছে, বাসে ঝুলন্ত অবস্থায় ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খেয়েই জখম হন সুদীপ্ত। এসএসকেএম হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে সিপিএম নেতা রবীন দেব এই ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খাওয়ার কথা মেনে নিয়েও অভিযোগ করেন, সুদীপ্ত বাস থেকে ছিটকে পড়ে যাওয়ার পরেও পুলিশ তার উপরে বেধড়ক লাঠি চালিয়েছে।
পুলিশ অবশ্য এই অভিযোগ স্বীকার করেনি। তাদের বক্তব্য, ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খেয়েই মারা গিয়েছেন সুদীপ্ত। সন্ধেবেলা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সুদীপ্তর মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বলেন, “কে কোন দলের, এ ক্ষেত্রে সেটা বড় কথা নয়। এ ভাবে দুর্ঘটনায় একটি তরুণ প্রাণ চলে গেল, এটা খুবই দুঃখের। আমি তাঁর পরিবারকে সমবেদনা জানাচ্ছি।”
লালবাজারে কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিম জানান, রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে আইন-অমান্য করতে গিয়ে মঙ্গলবার ৩৩১ জন এসএফআই কর্মী গ্রেফতার হন। তাঁদের ধর্মতলা থেকে প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। জেলের কাছেই একটি ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খান বাসের দরজায় ঝুলতে থাকা সুদীপ্ত গুপ্ত এবং দেবাশিস নন্দী নামে দু’জন এসএফআই কর্মী। সুদীপ্তকে এসএসকেএএম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয় দেবাশিসকে। |
|
মঙ্গলবার সমাবেশে যাওয়ার আগে কলেজ স্কোয়ারে
জড়ো হয়েছিলেন সুদীপ্তরা। সেখানেই তোলা হয় তাঁর এই ছবি। |
জাভেদের বক্তব্য, ওই বাসে কলকাতা পুলিশের দু’জন হোমগার্ড ছিলেন। দুই এসএফআই কর্মী পড়ে যাওয়ার পর অন্য এসএফআই কর্মীরা দুই হোমগার্ডকে মারধর করেন। এক হোমগার্ডকে গুরুতর জখম অবস্থায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই পুলিশ কর্তা বলেন, “জেলের বাইরের সিসিটিভি-র ক্যামেরায় ওই ঘটনার ছবি রেকর্ড করা রয়েছে। তাতেই স্পষ্ট, এসএফআই-এর কর্মীরাই মারধর করছেন পুলিশের দুই কর্মীকে। তাঁর দাবি, “অন্তত চার জন পুলিশ আহত হয়েছেন। তার মধ্যে বিশ্বজিৎ মণ্ডল নামে এক হোমগার্ডের আঘাত গুরুতর। দক্ষিণ কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয়েছে।” যুগ্ম কমিশনার বলেন, “চুলচেরা বিচারে এটাকে পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুই বলতে হবে। তবে প্রকৃত অর্থে পুলিশের হেফাজতে থাকা বলতে যা বোঝায়, আইন-অমান্যকারীরা তা থাকেন না।”
কলকাতা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এসএফআই সমর্থকদের ১৫১ ধারায় পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। তাই পুলিশি হেফাজতেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। আর হেফাজতে মৃত্যুর ক্ষেত্রে যা যা করণীয়, এ ক্ষেত্রেও তাই হবে।
কী কী করণীয়? পুলিশ জানিয়েছে, জাতীয় ও রাজ্য মানবাধিকার কমিশনকে ঘটনাটি জানানো হবে। মেডিক্যাল বোর্ড তৈরি করে, এক জন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ময়নাতদন্ত হবে। গোটা ময়নাতদন্তের প্রক্রিয়াই ভিডিওতে তুলে রাখা হবে।
এসএসকেএমের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সুদীপ্তর মাথা, চোখ এবং তলপেটে গভীর আঘাত ছিল। সুপার তমালকান্তি ঘোষ সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা নাগাদ সুদীপ্তর মৃত্যুর খবর ঘোষণা করেন। ভারী কিছুর আঘাতজনিত ক্ষত এবং তা থেকে রক্তক্ষরণের জেরেই মৃত্যু হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রে প্রাথমিক ভাবে জানানো হয়েছে। এ দিন দুপুরে ঘটনাস্থল থেকে পুলিশের গাড়িতেই সুদীপ্তকে প্রথমে এসএসকেএমের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন তাঁর মাথা ও মুখ থেকে অঝোরে রক্ত পড়ছে। সংজ্ঞা নেই। ইমার্জেন্সি থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে। সেখানে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
তবে সুদীপ্তর সতীর্থদের অভিযোগ, হাসপাতালে আনার পরে প্রায় আধ ঘণ্টা তাঁকে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ফেলে রাখা হয়েছিল। সুদীপ্তর সঙ্গে বাসে থাকা সুব্রত দত্ত বলেন, “ইমার্জেন্সিতে আসার পরে আমাদের টিকিট করিয়ে আনতে বলা হয়েছিল। আমরা বার বার বলেছি, ‘টিকিট করাচ্ছি। কিন্তু ডাক্তারকে ডাকুন।’ কেউ কথা শোনেননি। টিকিট হাতে পাওয়ার পরেই ওকে ছুঁয়ে দেখেন ডাক্তাররা।” হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সুদীপ্তর মৃত্যুর বিষয়ে কোনও তদন্ত হবে কি না, সে বিষয়ে রাত পর্যন্ত পুলিশের তরফে কিছু জানা যায়নি। তবে এ দিন রাতে নিজেকে প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করে পুলিশের বিরুদ্ধে হেস্টিংস থানায় অভিযোগ দায়ের করেন এসএফআই-এর কলকাতা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ডোনা গুপ্ত। |
|
|
ছেলেটা আর ফিরবে না। হাসপাতালে বিহ্বল সুদীপ্তর দিদি আর বাবা।—নিজস্ব চিত্র |
|
ঠিক কী ভাবে আহত হয়েছিলেন সুদীপ্ত? তাঁর বন্ধু তথা এসএফআই কর্মী দেবজ্যোতি দাসের দাবি, শিয়ালদহ থেকে তাঁরা যখন মিছিল করছিলেন তখনই কিছু তৃণমূল সমর্থক তাঁদের উত্যক্ত করতে শুরু করে। পুলিশও তখন থেকেই তৃণমূল কর্মী-সর্মথকদের পক্ষ নিয়ে তাঁদের উদ্দেশে কটূক্তি শুরু করে। দেবজ্যোতি বলেন, “আইন অমান্যের পরে পুলিশ মারতে মারতে সবাইকে বাসে তুলছিল। ঝড়ের গতিতে বাস চলছিল। প্রেসিডেন্সি জেলে ঢোকার মুখে বাসটা আচমকা ব্রেক কষে। এক পুলিশ কর্মীর ধাক্কায় সুদীপ্ত ছিটকে বাস থেকে বেরিয়ে সামনের ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খায়।” দেবজ্যোতির অভিযোগ, “ধাক্কা খাওয়ার পরে সুদীপ্তর নাক-মুখ থেকে ঝরঝর করে রক্ত বেরোচ্ছিল। তার পরেও পুলিশ ওকে লাঠি দিয়ে মেরেছে। বাকিরা বাধা দিতে গেলেতাদেরও অকথ্য ভাবে মারা হয়। মিনিট কয়েকের মধ্যে ও যখন নেতিয়ে পড়ে, তখন পুলিশের হুঁশ ফেরে।”
ঘটনার আর এক প্রত্যক্ষদর্শী শ্রীজীব গোস্বামী বলেন, “বাসের মধ্যেই এক পুলিশকর্মী সুদীপ্তের মুখে রুল দিয়ে মারেন। ও রাস্তায় পড়ে যাওয়ার পর আমরা প্রতিবাদ করি। তখন লাঠিচার্জ শুরু হয়। অনেকেই রাস্তায় পড়ে থাকা সুদীপ্তকে আড়াল করতে ঝাঁপায়। ধস্তাধস্তির সময় পুলিশও ওকে পা দিয়ে পিষে চলে যায়।” বিনা প্ররোচনায় পুলিশের অত্যাচারের অভিযোগ তুলেছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এসএফআইয়ের চার কর্মী বাঁশদ্রোণীর তনুশ্রী মণ্ডল, মথুরাপুরের রুদ্রপ্রসাদ গায়েন, উল্টোডাঙার বিধান আবাসনের সৌমেন মিত্র এবং হুগলির জিরাটের বাসিন্দা অভীক ঘোষ। এ দিন পুলিশের তরফ থেকেও এসএফআইয়ের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে হেস্টিংস থানায়। আহত পুলিশ কর্মী বিশ্বজিৎ মন্ডল পুলিশের কাছে যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তাতে তিনি বলেছেন, এসএফআইয়ের সমর্থকেরা তাঁকে মারধর করেছে। তাঁকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, বিশ্বজিৎবাবুর বুকে আঘাত থাকলেও শরীরে কোনও কাটাছেঁড়া নেই। প্রশ্ন উঠেছে, এসএফআই-সমর্থকদের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও আহত পুলিশ একটি ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল কেন?
এসএফআই সূত্রের খবর, সুদীপ্ত-সহ মোট পাঁচ জন আহতকে এসএসকেএম এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তিন জনকে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। জোসেফ আজম হোসেন নামে এক এসএফআই কর্মী গুরুতর আহত হয়ে মেডিক্যালে ভর্তি রয়েছেন। খড়গ্রামের ভালকুন্ডি গ্রামের বাসিন্দা জোসেফ বহরমপুর কলেজের বাংলা অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। মেডিক্যাল সূত্রের খবর, জোসেফের ডান হাতের শিরা কেটে গিয়েছে। হাড় ভেঙেছে। এসএফআই-এর রঘুনাথগঞ্জের আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক দেবাশিস রায় দাবি করেন, “পুলিশ সবাইকে বাসের মধ্যে ঠেলে তুলছিল। লাঠি দিয়ে গুঁতোচ্ছিল। লাঠির বাড়িতে বাসের জানলার কাঁচ ভেঙে জোসেফের হাতে ঢুকে যায়।”
আজ, বুধবার সুদীপ্তর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। |
|
|
|
|
|