|
|
|
|
ওঁদের নতুন গ্রহ |
ক্রিকেটাররা মিশছেন বলিউডের সঙ্গে। কেউ করছেন গোল, কেউ মারছেন ছক্কা।
খেলা এবং
বিনোদন জগতের তারকাদের এ এক আশ্চর্য মিশেল।
কী পাচ্ছেন তাঁরা?
খোঁজ নিলেন অনিলাভ চট্টোপাধ্যায় |
দিল্লির লা মেরিডিয়ান হোটেলের বেসমেন্টে ডিনার পর্ব তখন শেষ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করছেন অভিষেক বচ্চন, রণবীর কপূর, ডিনো মোরিয়া। হঠাৎই চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে অভিষেকের ঘোষণা, “বন্ধুরা, তোমরা আজ দারুণ খেলেছ। ব্যাড লাক, আমরা জিতিনি। বাট আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ বয়েজ।” ব্যাঙ্কোয়েট ফেটে পড়েছে হাততালি আর চিৎকারে। অভিষেক আবার বলতে শুরু করলেন, “কিন্তু আরও একটা ঘোষণা। কাল ঠিক সকাল দশটায় হোটেল থেকে এয়ারপোর্টের বাস ছাড়বে। যে মিস করবে, তাকে আর সক্কালের ফ্লাইটে মুম্বই ফিরতে হচ্ছে না। দশটা মানে ঠিক দশটা।”
পর দিন কী হয়েছিল সেটা জানা নেই। তবে মনে পড়ে গেল কয়েক দিন আগে আমাদের বেঙ্গল টাইগার্স টিমের একটা ছোট ঘটনা। হায়দরাবাদে ম্যাচের আগের দিন স্থানীয় একটা অ্যাকাডেমিতে প্র্যাকটিস আমাদের। ক্রিকেট কনসালট্যান্ট দীপ দাশগুপ্ত লাঞ্চেই টিমকে জানিয়ে দিয়েছিল, ‘চারটেয় লবি। চারটে পনেরোর মধ্যে আমরা বেরিয়ে যাব।” সওয়া চারটের মধ্যে লবিতে হাতে গোনা কয়েক জন ক্রিকেটারকে পাওয়া গেল। ঠিক চারটে কুড়িতে দীপের সিদ্ধান্ত, “এ বার যারা আসবে, নিজেদের আসতে হবে। চলো বাস ছেড়ে দিই।’’ হলও তাই। যিশু সেনগুপ্তের মতো কয়েক জন তারকা প্র্যাকটিসে এল নিজেদের উদ্যোগে, হোটেল থেকে গাড়ি জোগাড় করে। অথচ কোনও রকম অভিযোগ, অনুযোগ, বিরক্তি, অসন্তোষ নেই। যিশুরা জানে এদের ওই মঞ্চটা একেবারে আলাদা। এটা রিয়েলিটির দুনিয়া। এখানে সবটাই টিম। এখানে সবার সঙ্গে সবার মতে থাকতে হবে। এই দুনিয়ায় প্রবেশের শর্ত যেন ওটাই। স্টারডমের পোশাকটা বাইরে খুলে এই পৃথিবীতে আসুন। এটা সাম্যবাদের দুনিয়া। |
|
হরভজন সিংহ এবং রণবীর কপূর |
অদ্ভুত ভাবে দেব-জিৎ কিংবা অভিষেক-রণবীররা মানিয়েও নিচ্ছেন। একটা সিসিএল কিংবা সেলিব্রিটি ম্যাচ খেললে ওদের কী কী প্রাপ্তি থাকতে পারে? দর্শকদের উল্লাস, উত্তাপ, চিৎকারসে তো ওঁরা পেয়েই যাবেন। ভরা স্টেডিয়াম। সেটাই বা নতুন কী! টাকা! যে টাকার বিনিময়ে ওঁরা সেলিব্রিটি ক্রিকেট লিগ খেলেন, সেটা একেবারেই বিবেচনার মধ্যে পড়ে না। সে আমাদের দেব, জিৎ, যিশুরাই শুধু নন। গোটা ভারতের সব ক’টা ইন্ডাস্ট্রি জুড়ে একই ছবি। রীতেশ দেশমুখ, সুনীল শেঠি কিংবা মনোজ তিওয়ারি, বেঙ্কটেশ, মোহনলালেরা তবু খেলছেন এ ভাবেই। ওঁদের দৈনিক পারিশ্রমিকের হিসেবের নামমাত্র টাকা ওঁরা পাচ্ছেন ক্রিকেট খেলে। সঙ্গে যোগ করুন তিন মাসের প্রস্তুতি পর্ব। এক শহর থেকে অন্য শহরে ছুটে বেড়ানো, নিজেদের ব্যস্ত শিডিউল থেকে সময় বের করা, চোট আঘাতের সম্ভাবনা সব কিছু। অথচ এ সব দূরে সরিয়ে রেখে ওঁরা ক্রিকেটে বিভোর তা হলে কেন?
সেলিব্রিটি ক্রিকেট লিগের সঙ্গে গত দু’ বছর ব্যক্তিগত ভাবে জড়িয়ে থেকে আমার মনে হয়েছে জয় কিংবা পরাজয়ের চটজলদি ফর্মুলাটা হয়তো কোনও ভাবে আকর্ষণ করছে তাঁদের সবাইকে। এটা অনেকটা ইনস্ট্যান্ট কফির মতো স্ট্রং। ওঁদের দুনিয়ায় জয় কিংবা পরাজয়ের অপেক্ষাটা থাকে অনেক দিনের। দীর্ঘ সময়ের পর একটা শুক্রবার। একটা দীর্ঘ সময়ের প্রস্তুতি, পরিশ্রম সবটার ভাগ্য দর্শকদের হাতে। কয়েক ঘণ্টায় সব শেষ। খেলার মাঠের নতুন মঞ্চের চিত্রনাট্যটা ওঁরা যেন এই জন্যই তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছেন।
সেলিব্রিটি ক্রিকেট লিগ চালুর ভাবনাটা যাঁর মাথায় এসেছিল, সেই বিষ্ণু ইন্দুরি হায়দরাবাদের লোক। প্রথম দিকে তেলুগু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির লোকজনকে নিয়ে কয়েকটা এগজিবিশন ম্যাচ আয়োজন করে বিষ্ণুরা দেখলেন প্রচুর লোকজন আসছেন। আর অভিনেতারাও উপভোগ করছেন বিস্তর।
শনিবার দিল্লির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে অভিষেকদের খেলার দিন বিবিএমে তাই বারবার খোঁজ নিচ্ছিলেন বিষ্ণু। ঠিক কত লোক স্টেডিয়ামে? এটা কি সেই চিরাচরিত কলকাতার ফুটবল আর ক্রিকেটের লড়াই নয়? যুবভারতী ভরলে সিএবি কর্তাদের মুখ ভারী হয়ে যায়। কিংবা ইডেন ভরলে ফুটবল অফিশিয়ালদের। এটা বরং একটা তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। ফিল্ম স্টাররা খেলার মাঠে সত্যিই যদি কম্পিটিটিভ থাকে তা হলেও মাঠ ভরবে, দর্শকেরা খেলা দেখবেন। সচিন কিংবা ওডাফাকেই সব সময় দরকার তা নয়। দিল্লির স্টেডিয়ামে হাজার পনেরো লোক দেখে অভিষেক- রণবীরদের অল স্টার টিমের প্রোমোটার প্রডিউসার বান্টি ওয়ালিয়ার মুখ শুকনো। দায় চাপাচ্ছিলেন স্পনসর এক সংস্থার ওপর। তাদেরই নাকি দায়িত্ব ছিল সব প্রমোশনের। আর ম্যাচের প্রমোশনটাই ভাল ভাবে হয়নি। কিন্তু পনেরো হাজার দর্শক শুনে বিষ্ণু উচ্ছ্বসিত। “ওদের বলো, প্রথম ম্যাচে যথেষ্ট ভাল ক্রাউড। ভুলে যেও না এটা ক্রিকেট নয়। ফুটবল। তাতেই এত মানুষ। সামনের দিনে আরও বেশি লোক আসবেই।”আমার নিজের সন্দেহটা ছিল অন্য জায়গায়। অভিষেক, রণবীরদের টিম বাসে চেপে স্টেডিয়ামের দিকে যখন এগোচ্ছি, তখনও বাসের ভিতরের অ্যামবিয়েন্সটা কোথাও বলছে না ওঁরা খেলাটা এতটা সিরিয়াস ভাবে নিয়েছে। রণবীর এমনিতেই চুপচাপ। প্রচণ্ড মজা করে চলেছেন অভিষেক। দলের ফুটবলার তালিকায় রাজস্থান রয়্যালসের মালিক, শিল্পা শেঠির পতিদেব রাজ কুন্দ্রা। অভিষেক রাজের সঙ্গে মজা করে চলেছেন, “তোমাদের আইপিএল-এ এ সব হয়! দেখে নাও, শিখে নাও!” পরক্ষণেই দলের সবাইকে বলছেন, “আচ্ছা ক্রিকেটাররা বল ধরলেই কিন্তু আমরা এলবিডব্লিউ-এর অ্যাপিল করব। হাউজ দ্যাট!” হাসিতে ফেটে পড়ছে গোটা বাস। সন্দেহটা এখানেই ছিল। অভিষেক, রণবীর, কিংবা বিরাট, ধোনিকে দেখতে হয়তো প্রথম দিন মাঠে মানুষ থাকবে। টিভি’র সামনেও কিছু ক্ষণ বসবে। কিন্তু তার পর? খেলার মান, সেলিব্রিটিদের পারফরম্যান্স যদি ঠিক না থাকে, তা হলে কিন্তু অল স্টার ফুটবল ক্লাবের ভবিষ্যৎ দু’টো একটা প্রদর্শনী ম্যাচেই শেষ হয়ে যাবে। আর টিম বাসে অভিষেক বচ্চনদের বডি ল্যাঙ্গোয়েজে মনে হচ্ছিল, এটা যেন ভবিতব্য হতে চলেছে। |
|
|
করণ ওয়াহি এবং যুবরাজ সিংহ |
বিরাট কোহলি এবং অভিষেক বচ্চন |
|
অথচ ড্রেসিংরুমে ঢুকতেই গোটা টিমটার চেহারা বদলে গেল। অভিষেক হয়ে গেলেন আর্মি কম্যান্ডার। হাসি উধাও। চোয়াল শক্ত। এতটুকু সময় নষ্ট নয়। কোচ বাইচুং ভুটিয়া অভিনেতাদের টিম নিয়ে ওয়ার্ম আপ করালেন টানা আধ ঘণ্টা। সুনীল ছেত্রীর টিম ক্রিকেটারস বরং মাঠে নামল অনেকটা পর। বাইচুংয়ের প্রেসক্রিপশন ছিল ম্যাচের টাইম কমিয়ে ত্রিশ-ত্রিশ মিনিটের করে দাও। অভিনেতারাই মানলেন না। এবং নব্বই মিনিট খেলে এক বারও থামলেন না রণবীর কপূর, ডিনো মারিয়া, সচিন যোশীরা। যথেষ্ট ভাল মানের ফুটবলার রণবীর, আদিত্য রায় কপূর কিংবা বরুণ ধাওয়ানরা। রণবীরকে দেখে তো বাইচুংও মুগ্ধ। “ও আরও কয়েক সেকেন্ড আগে যদি বলটা রিলিজ করে দেয়, তা হলে ওকে ধরে রাখা যাবে না, ” বললেন বাইচুং। ম্যাচটায় ৪-৩ এ জয় ক্রিকেটারদের। অথচ অভিনেতারাই জিততে পারত। রণবীর নিজে পেনাল্টি নষ্ট করলেন। ডিনো ফাঁকা গোলে বল ঠেলতে পারলেন না। সাবির অহ্লুওয়ালিয়ার হেড বারে লাগল। অন্য দিকে মনোজ তিওয়ারি ফাটিয়ে খেললেন। দু’টো দারুণ গোল করলেন। ম্যাচের সেরা ফুটবলটা খেললেও যে মনোজ কলকাতার ক্লাব ফুটবলে দাপিয়ে খেলতে পারতেন বোঝা যাচ্ছিল। বেশ ভাল ফুটবল খেলেন বিরাট কোহলি, ধোনিও। ধৈর্য এবং ফিটনেসের দিক থেকেও ওরা অনেকটাই এগিয়ে। নিয়মিত খেলার মধ্যে থাকেন। কিন্তু ক্রিকেটারদের বেশ চ্যালেঞ্জের মুখেই ফেলে দিয়েছিলেন অভিষেকরা। অভিষেক ছিলেন স্টপার। ম্যাচে রীতেশ সাইড ট্যাকল করছিলেন। আর তাতেই রীতিমতো বিস্মিত কোহলি, দিন্দারা। ম্যাচ শেষে ওঁদের গ্যাংনাম ডান্স দেখেই বোঝা যাচ্ছিল আর যাই হোক ম্যাচটা খুব বেশি প্রীতিময় ছিল না। ধোনি যেমন খোঁজ নিচ্ছিলেন ঋদ্ধিমানের। “সাহা কোথায়? ও তো ফুটবলটা খুব ভাল খেলে! ওকে ডাকা উচিত ছিল।”
সিসিএল-এ সোহেল খানের মুম্বই টিম সম্পর্কে চালু ধারণা, ‘এরা আফটার ম্যাচ পার্টিতে খেলে। স্টেডিয়ামে খেলে ওদের বিপক্ষ দল।’ অভিষেক, রণবীরদের ফুটবল টিম নিয়ে কিন্তু অভিযোগ আনা যাবে না। কারণটা সহজ। বলিউডের এই জেন ওয়াইয়ের বেশির ভাগেরই স্কুল কিংবা কলেজ লাইফের একটা বড় অংশ কেটেছে ইউরোপের কোনও শহরে। আমচি মুম্বই হয়েও তাই ফুটবলটা প্রায় সবাই খেলেছেন। এই টিমের সঙ্গে জন আব্রাহাম, আরশাদ ওয়র্সিরা যোগ দিলে অল স্টার ফুটবল ক্লাব কিন্তু রীতিমতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষ।
আর এটাই ভবিষ্যৎকে আলো দেখাচ্ছে। অভিষেক, রণবীরদের স্টার ভ্যালু থাকছে, পারফরম্যান্সটাও থাকছে এর সঙ্গে টিভি প্রচার, এনটারটেনমেন্ট কোশেন্টগুলো যদি ঠিকঠাক মিশে যায়, তা হলে সেলিব্রিটি ফুটবলটাও এ দেশে বড় সম্পদ হয়ে উঠবে না, কে বলতে পারে!
সিসিএল-এর মতো হয়তো চালু হয়ে যাবে সিএফএল সেলিব্রিটি ফুটবল লিগ।
অভিনেতারা এই মঞ্চে শুধু জিততে চাইছেন। রিয়েল লাইফে জয়ের যে উত্তেজনা, রোমাঞ্চ সেটাকে উপভোগ করতে চাইছেন পূর্ণমাত্রায়। এই জগতে সবটা আসল। জয়টা আসল, পরাজয়টাও বাস্তব। বাস্তবে পরাজয়টা আর কে চায়!
রণবীর, অভিষেকদের ফুটবলও নিঃসন্দেহে এই রাস্তা ধরেই এগোবে। ধোনি, কোহলিদের বিরুদ্ধে দারুণ ম্যাচ, ওই অনবদ্য লড়াই নিঃসন্দেহে সাহস জোগাবে ওঁদের। আগামী দিনে তাই আরও সেলিব্রিটি ফুটবলের জন্য অপেক্ষা করুন। অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রি থেকে ফুটবল টিমও তাই শুধু সময়ের অপেক্ষা। বাংলা কি আর ফুটবলে পিছিয়ে থাকবে? আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে ভাল ফুটবলার অনেক। তবে দায়িত্ব নিতে হবে এই ইন্ডাস্ট্রিরই কাউকে। ‘মিস্টার বাংলা ইন্ডাস্ট্রি’ কেমন চয়েস হবেন?
ও বুম্বাদা, শুনছেন? |
|
|
|
|
|