মাত্র এক মাসের ওষুধের দামই প্রায় দেড় লক্ষ টাকা ছুঁইছুঁই! তা-ও আবার ক্যানসারের মতো রোগের, যাতে কি না আক্রান্ত অধিকাংশ মানুষকে ওষুধটা প্রায় জীবনভর খেয়ে যেতে হয়। সেই ওষুধেরই পেটেন্ট-নিরাপত্তা চেয়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছিল প্রস্তুতকারী বিদেশি এক বহুজাতিক। সাত বছর মামলা চলার পরে সোমবার সুপ্রিম কোর্ট তাদের আবেদন খারিজ করে দিল।
ফলে ওষুধটির উপরে বহুজাতিক সংস্থাটির কোনও একচেটিয়া অধিকার থাকছে না। একাধিক দেশি সংস্থা ইতিমধ্যে একই ধরনের ওষুধ বহু গুণ কম দামে এ দেশের বাজারে বিক্রি করছে, বহুজাতিকের পেটেন্ট-নিরাপত্তা কায়েম হলে যা করা যেত না। সুপ্রিম কোর্টের এ দিনের রায় শুনে দেশীয় সংস্থাগুলির পাশাপাশি হাঁফ ছেড়েছেন বহু সাধারণ রোগীও। অন্য দিকে সংশ্লিষ্ট ওই সুইস বহুজাতিক ‘নোভার্টিস’ ঘটনাটিকে ভবিষ্যৎ আবিষ্কার-উদ্যোগের পথে প্রতিবন্ধক হিসেবে অভিহিত করেছে। এবং জানিয়ে দিয়েছে, উদ্ভুত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তারা আর ভারতে গবেষণাখাতে টাকা ঢালবে না।
ফলে স্বস্তির পাশাপাশি তৈরি হয়েছে একটা গুরুতর সংশয়ও পেটেন্টের ছাতা সরালে এ দেশে বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর গবেষণা-স্রোত বাধাপ্রাপ্ত হবে না তো? চিকিৎসকমহলের একাংশের গলাতেও শোনা গিয়েছে তার সুর। নোভার্টিস আদালতে গিয়েছিল কেন?
ড্রাগ কন্ট্রোল-সূত্রের খবর: রক্তের ও পেটের ক্যানসারের চিকিৎসায় ‘ইমাটিনিভ মেসিলেট’ নামে এক যৌগ থেকে তৈরি একটি ওষুধ (গ্লিভেস) তারা বাজারে এনেছিল, বিশ্ব জুড়ে যা ব্যাপক হারে প্রয়োগ হচ্ছে। নোভার্টিস তার পেটেন্ট-ও নিয়ে নিয়েছিল। এ দিকে ভারতের পেটেন্ট-আইন মোতাবেক, কুড়ি বছর পরে পেটেন্টের অধিকার আপনা-আপনি বাতিল হয়ে যায়। সেই ভাবে নোভার্টিসের পেটেন্টের মেয়াদও ফুরিয়ে যাওয়ার পরে তিনটি ভারতীয় সংস্থা ‘ইমাটিনিভ মেসিলেট’ দিয়েই তৈরি একই রকম ওষুধ বাজারে আনে। নোভার্টিসের ওষুধের তুলনায় তার দাম বিস্তর কম।
স্বভাবতই সস্তা ওষুধ বিপুল বাজার পেয়ে যায় এ দেশে। এর পরেই নোভার্টিস ভারতীয় পেটেন্ট কমিশনে আবেদন জানিয়ে বলে, তারা গবেষণার মাধ্যমে আগের যৌগে কিছু পরিবর্তন এনে উন্নততর ওষুধ বানিয়েছে, যা কি না মানবদেহে আরও দ্রুত মিশে যাবে, ফলে কাজ হবে আরও ভাল। ওষুধটিকে ‘নতুন’ হিসেবে দাবি করে তার পেটেন্ট চায় নোভার্টিস। কিন্তু কমিশন তা নাকচ করে জানায়, এটা নতুন ওষুধ নয়, পুরনোটিরই আধুনিক সংস্করণ মাত্র। এতে ‘নতুন ওষুধের’ পেটেন্ট দেওয়া যাবে না। নোভার্টিস তখন সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়।
সেই মামলাই চলেছে সাত বছর ধরে। এ দিন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নোভার্টিসের আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আফতাব আলম ও বিচারপতি রঞ্জনাপ্রকাশ দেশাইয়ের বেঞ্চও ইমাটিনিভ মেসিলেট-কে নতুন ওষুধ কিংবা নতুন আবিষ্কারের ফলাফল হিসেবে মানতে রাজি হয়নি। কাজেই নতুন পেটেন্টেরও প্রশ্ন থাকছে না। “গবেষণালব্ধ আবিষ্কারের মূল্যমানের পরিবর্তে বিভিন্ন কোম্পানির দাবির কুশলী পরিবেশনার ভিত্তিতে পেটেন্ট নির্ধারিত হওয়াটা কখনওই উচিত নয়।” রায়ে বলেছে বেঞ্চ। যার অর্থ, ভারতীয় সংস্থাগুলো তাদের সস্তা ওষুধের বিক্রি জারি রাখতে পারবে।
রায়কে স্বাগত জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ড্রাগ কন্ট্রোল এবং রোগী-স্বার্থে নিয়োজিত বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তাদের বক্তব্য: নোভার্টিসের পেটেন্ট-নিরাপত্তা বলবৎ থাকলে মধ্যবিত্ত ক্যানসার রোগীর চিকিৎসার অধিকারই কেড়ে নেওয়া হতো। সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ অ্যাখ্যা দিয়ে ভারতের ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল জ্ঞানেন্দ্রনাথ সিংহ বলেন, “এতে রোগীদের কম দামে ওষুধ কেনার অধিকার রক্ষিত হল। বিদেশি সংস্থা মর্জিমাফিক দাম নিত, যা অধিকাংশ ভারতীয়ের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।” পশ্চিমবঙ্গের ড্রাগ কন্ট্রোলার চিন্তামণি ঘোষের প্রতিক্রিয়া, “কিছু সংস্থার অদ্ভুত প্রবণতা আছে পুরনো ওষুধের নামমাত্র পরিবর্তন করে নতুন হিসেবে পেটেন্ট চাওয়া। যাকে এভারগ্রিনিং বলা হয়। আমরা এর বিরুদ্ধে। সুপ্রিম কোর্ট ও পেটেন্ট কমিশন ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
ক্যানসার-চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো যে ভাবে পেটেন্ট নিয়ে ওষুধের দাম আকাশছোঁয়া করে রাখে, তাতে নিয়ন্ত্রণ জরুরি। নচেৎ চিকিৎসা শুধু মুষ্টিমেয় মানুষের কুক্ষিগত থাকবে।” আবার ক্যানসার শল্য-চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় সংশয়ও প্রকাশ করেছেন। “বহুজাতিক সংস্থাগুলো গবেষণার পিছনে বহু টাকা খরচ করে। ওষুধের দামও বাড়িয়ে রাখে। দেশে পেটেন্টের নিরাপত্তা না-পেলে ভবিষ্যতে গবেষণায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে না তো?” প্রশ্ন তুলেছেন গৌতমবাবুর মতো কিছু চিকিৎসক। সংস্থার ভারতীয় শাখার (নোভার্টিস ইন্ডিয়া) ভাইস চেয়ারম্যান তথা ম্যানেজিং ডিরেক্টর রঞ্জিত সাহনি নয়াদিল্লিতে সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়ে দিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা এ দেশে গবেষণায় বিনিয়োগ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। “আমরা এ দেশে নতুন ওষুধ আনব ঠিকই, তবে এখানে আরঅ্যান্ডডি’তে টাকা ঢালব না।” বলেন তিনি। ভারতের আরঅ্যান্ডডি’কে তাঁরা অন্য ‘অনুকূল’ জায়গায় নিয়ে যাবেন বলে জানান নোভার্টিস-কর্তা। সংস্থার অভিযোগ: তাদের গবেষণালব্ধ ফল ‘টুকে’ ওষুধ বানাচ্ছে কিছু দেশি সংস্থা, যা নোভার্টিসের তৈরি ওষুধের মানের সঙ্গে তুলনীয় নয়। এই রায়ের ফলে ভারতের রোগীরা উন্নত মানের ওষুধ থেকে বঞ্চিত হবেন। তাঁদের চিকিৎসাও বিলম্বিত হবে বলে সংস্থার তরফে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। |